সূরা আস সাফফাত কোরআনে কারিমের ৩৭তম সূরা। সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই সূরায় বিশ্বাসগত বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে জিন ও ফেরেশতা সম্পর্কে মানুষের কিছু ভুল ধারণা তুলে ধরে তা থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে।
ইরশাদ হয়েছে, ‘শপথ তাদের যারা (সুশৃঙ্খল ও দৃঢ়ভাবে) সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো, এবং শপথ সেই বাধা প্রদানকারীদের (যারা অন্যদেরকে গোনাহর কাজে) কঠোরভাবে বাধা প্রদান করে; এবং শপথ জিকিরকারীদের (আল্লাহর আয়াত); নিশ্চয়ই তোমাদের মাবুদ একজন। তিনি আসমানসমূহ, জমিন ও এই দুয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর পালনকর্তা এবং পালনকর্তা পূর্ব দিকসমূহের।’- সূরা আস সাফফাত: ১-৫
এই আয়াতের তাফসিরে আলেমরা বলেছেন, মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এই সূরা কয়েকটি শপথের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। এটা স্পষ্ট যে, আমাদেরকে কোনো কিছু বোঝানোর জন্য আল্লাহতায়ালার কসম খাওয়ার প্রয়োজন নেই। ঈমানদাররা আল্লাহর কথা এমনিতেই বিশ্বাস করে ও মাথা পেতে নেয়। কিন্তু বিষয়বস্তুর গুরুত্ব ও বিশালত্বের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আল্লাহতায়ালা এখানে শপথ করে নিজের আহ্বান তুলে ধরেছেন।
তিনি এখানে এমন কিছু ফেরেশতার নামে শপথ করেছেন যারা নবী-রাসূলদের কাছে আল্লাহ অহি নিয়ে আসেন। একইসঙ্গে এসব অহি যাতে সম্পূর্ণ শুদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গরূপে নবী-রাসূলদের কাছে পৌঁছাতে পারে সেজন্য তারা নবীদের কাছে পৌঁছানোর আগে অহির ওপর মানুষ ও শয়তান যাতে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে না পারে সেজন্য অতন্ত্র প্রহরী হিসেবে কাজ করেন।
ফেরেশতাদের এই দলটির প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা সুশৃঙ্খল ও সারিবদ্ধভাবে চলাফেরা করে। আমরা ফেরেশতাদের দেখতে পাই না বলে এই শৃঙ্খলা উপলব্ধি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আল্লাহ অহির মাধ্যমে মানুষকে একথা জানিয়ে দিয়েছেন এটা বোঝানোর জন্য যে, ফেরেশতাদের মধ্যে সর্বোচ্চ শৃঙ্খলা রয়েছে এবং তারা আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য সদা প্রস্তুত।
ফেরেশতারা আল্লাহতায়ালার নির্দেশ পাওয়া মাত্র তা বাস্তবায়ন করে এবং এই পথের সব বাধা অপসারণ করে। এ সম্পর্কে শপথ করার পর পবিত্র কোরআনে বলা হচ্ছে, আসমানসমূহ, জমিন ও সব সৃষ্টির স্রষ্টা হচ্ছেন এক আল্লাহ এবং তার কোনো শরিক নেই। ফেরেশতা ও জিনসহ আসমান-জমিনে এমন কারও অস্তিত্ব নেই এই বিশ্বজগত সৃষ্টি ও পরিচালনায় যার কোনো হাত আছে। আল্লাহ শুধু সৃষ্টিকর্তাই নন বরং গোটা বিশ্বজগত পরিচালনার ভারও নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন।
বর্ণিত আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে-
এক. ইসলামে যেকোনো কাজ সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কাজে শৃঙ্খলা থাকলে তা সুষ্ঠুভাবে এবং যথাসময়ে সম্পন্ন হয়।
দুই. যেকোনো লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা থাকে। এসব প্রতিবন্ধকতায় ভয় পেলে চলবে না; বরং এগুলো অপসারণ করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টায় অটল থাকতে হবে।
তিন. আল্লাহতায়ালা শুধু এই বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা নন সেইসঙ্গে তিনি এর পালনকর্তাও বটে।
চার. বিশ্বজগতের সব সৃষ্টি আল্লাহতায়ালার একক নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। আসমান ও জমিন এবং এর মধ্যে যা কিছু রয়েছে সেগুলোর সুশৃঙ্খল কর্মতৎপরতাই আল্লাহতায়ালার একত্ববাদের সাক্ষ্য দেয়।
সূরা সাফফাতের পরের আয়াতগুলোতে আল্লাহ পাক বলছেন, ‘নিশ্চয় আমি নিকটবর্তী আকাশকে তারকারাজি দ্বারা সুশোভিত করেছি।’
আসমান ও জমিনের সৃষ্টিকর্তা যে এক আল্লাহতায়ালা- আগের আয়াতে সে কথা উল্লেখের পর বলা হচ্ছে, ‘তোমাদের মাথার ওপর যে আকাশ রয়েছে অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠ থেকে সবচেয়ে নিকটবর্তী আকাশকে আমি তারকা দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছি।’ আল্লাহতায়ালার এই বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন করা বর্তমান সময়ের নগরবাসীর জন্য একটু কঠিন। কারণ, বাস্তবতা হচ্ছে কোলাহলপূর্ণ ও ঘনবসতিময় শহরে রাতের বেলা ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও দোকানপাট বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমল করে বলে আকাশের তারকারাজি তেমন জ্বলজ্বলে দেখা যায় না।
রাতে শহরের আকাশের দিকে তাকালে খুব অল্প সংখ্যক তারকা দেখা যায় যেগুলোর ঔজ্জ্বল্য বৈদ্যুতিক আলোর কাছে অনেকটা ম্লান। কেউ ইচ্ছে করে আকাশের দিকে না তাকালে আকাশের তারকা তার চোখেই পড়ে না। কিন্তু শহর থেকে দূরে নির্জন স্থানে রাতের আকাশের সৌন্দর্য সত্যিই উপভোগ করার মতো। সে সৌন্দর্য বর্ণনা করার মতো নয়। আল্লাহতায়ালা এই আয়াতে আকাশের তারকারাজিকে যেন এমন বাতির সঙ্গে তুলনা করেছেন কোনো উৎসবে যে বাতি জ্বালানো হয়। কিছু তারকা আছে যেগুলো অনেক দূর থেকে একবার জ্বলে আবার নিভে যায় এবং কিছু তারকা আছে যেগুলোর আলো একইরকমভাবে স্থায়ী থাকে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো-
এক. মানুষ স্বভাবগতভাবে সৌন্দর্য পিয়াসী। কাজেই প্রকৃতিতে ছড়িয়ে থাকা সৌন্দর্য উপভোগ করতে উৎসাহ যুগিয়েছে পবিত্র কোরআন।
দুই. আকাশের তারকারাজি আল্লাহর বিশাল ক্ষমতার অন্যতম নিদর্শন।
তিন. মুসলিম পণ্ডিত ও চিন্তাবিদরা আকাশের গ্রহ, নক্ষত্র সম্পর্কে গবেষণা করে এ ব্যাপারে নতুন নতুন জ্ঞান অর্জনের তাগিদ দিয়েছেন।