নারীদের ওপর কখন হজ ফরজ?

, ইসলাম

ড. মুফতি মুহাম্মদ গোলাম রব্বানী, অতিথি লেখক, ইসলাম | 2023-09-01 16:32:53

১৪ জুলাই শুরু হবে হজ ফ্লাইট। বাংলাদেশ থেকে এবার প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলামান হজপালনের জন্যে সৌদি আরব গমন করবেন। এবার যারা হজে যাচ্ছেন, তাদের প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই। হজ পালনেচ্ছুদের সুবিধার্থে বার্তা২৪.কম ধারাবাহিকভাবে হজের নিয়ম-কানুন, মাসয়ালা, আমল ও প্রয়োজনীয় দোয়া প্রকাশ করবে। আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব

নারীদের বাইরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে ইসলামি শরীয়ত বেশ কিছু বিধি-নিষেধ দিয়েছে। এর অন্যতম হলো- শরয়ী সফরের দূরত্বে যাতায়াত করতে হলে তার সঙ্গে স্বামী বা মাহরাম থাকতে হবে।

শরয়ী সফর হলো- ৪৮ শরয়ী মাইল বা ৫৪ মাইল বা ৮৭ কিলোমিটার পথ সফর করা। তা পায়ে হেঁটে হোক, রেল, বাস বা প্লেনে হোক। একদিন বা পাঁচদিন যত সময়ের জন্যই হোক নারীরা ৮৭ কিলোমিটার পথ মাহরাম ছাড়া একা চলবে না। পার্থিব প্রয়োজনেও একা যাবে না। হজ-উমরা ইত্যাদির মতো শরীয়তের প্রয়োজনেও একা চলাফেরা করবে না।

মনে রাখতে হবে, হজ-উমরা হলো আল্লাহর বিধান। তা আল্লাহর বিধান মতো পালন করলেই এতে সওয়াব ও মুক্তি আছে। মনগড়া নিয়মে তা পালন করলে উল্টো গোনাহগার হতে হবে।

মাহরাম কারা?
মাহরাম বলতে বুঝায় যাদের সঙ্গে শরীয়তের দৃষ্টিতে বিয়ে বৈধ নয়। যেমন- ছেলে, পিতা, আপন চাচা, আপন মামা, ভাই, নাতী, শ্বশুর ও মেয়ের জামাই।

মাসয়ালা : খালাতো ভাই, মামাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, চাচাতো ভাই মাহরাম নয়। তাদের সঙ্গে বিয়ে জায়েজ। এমনিভাবে মুখে মুখে ডাকা বাপ, ছেলে বা ভাই, পালক পুত্র মাহরাম হিসেবে গণ্য হবে না।

নারীদের ওপর কখন হজ ফরজ?
নারীদের ওপর হজ ফরজ হওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত হলো- নারী নিজে ও তার সঙ্গের মাহরামের হজের খরচের ব্যবস্থা হতে হবে। তাহলেই তার ওপর হজ ফরজ হবে।

এক কথায়-
ক. যদি নারীর নিজের হজের খরচের ব্যবস্থা থাকে।
খ. তার সঙ্গে যাতায়াতের জন্য মাহরামের ব্যবস্থা হয়।
গ. মাহরামের হজের খরচের ব্যবস্থা তার কাছে থাকে।
ঘ. নারীদের ঘর থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যকোনো নিষেধ না থাকে (যেমন তালাকের ইদ্দত বা স্বামীর মৃত্যুর ইদ্দতকালীন সময় না হয়)। তাহলে নারীদের ওপর হজ করা ফরজ হবে এবং তা আদায় করতে হবে।

মাসয়ালা : নারীদের ওপর হজ ফরজ হলে তা আদায়ের ক্ষেত্রে স্বামী বাধা দিলেও তা মানা যাবে না। তবে নফল হজের ক্ষেত্রে স্বামীর অনুমতি নেওয়া জরুরি।

মাসয়ালা : কোনো নারীর টাকার ব্যবস্থা আছে কিন্তু উপযুক্ত মাহরাম বা স্বামী না থাকায় হজ করতে না পারলে বদদি হজের অসিয়ত করে যাবে। তার মৃত্যুর পর তার সম্পদের এক তৃতীয়াংশ দ্বারা তা আদায় করা হবে।

মাসয়ালা : নারীরা অন্য নারীর সঙ্গে মিশে স্বামী বা মাহরাম ছাড়া হজ করতে পারবে না। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো নারী মাহরাম ব্যতীত যেন হজ না করে।’ -সাঈদ আব্দুল কাদের, আল মুগনি ফি ফিকহিল হজ ওয়াল উমরা, পৃ. ২২ সূত্রে হজ উমরা ও যিয়ারত গাইড, শামসুল হক সিদ্দিক পৃ. ১৫২

নারী-পুরুষের হজে পার্থক্য
হজের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের খুব বেশি পার্থক্য নেই। হজে পুরুষদের যে সব কাজ করতে হয়, নারীদেরও সেসব কাজ করতে হয়। অল্প কিছু ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে তা আলোচনা করা হলো-

১. পুরুষ সঙ্গী : পুরুষরা একা হজ করতে পারলেও নারীদের হজ-উমরার ক্ষেত্রে তার সঙ্গে স্বামী বা মাহরাম পুরুষ থাকতে হবে। মাহরাম পুরুষ না পাওয়া গেলে হজ স্থগিত রাখবে।


২. পোশাক : হজের ইহরাম অবস্থায় পুরুষরা সেলাইবিহীন লুঙ্গি ও চাদর পরিধান করেন। অপরদিকে নারীরা স্বাভাবিক পর্দা করবেন। নারীরা মুখের সঙ্গে কোনো কাপড় লাগিয়ে রাখবেন না। মুখের পর্দার জন্য মাথার সামনে ক্যাপ দিয়ে, ক্যাপের সামনে বাড়তি কাপড় ঝুলিয়ে দিতে পারেন। তাছাড়া নারীরা সেলাইযুক্ত সাধারণ কাপড় পরিধান করার পাশাপাশি মাথা ঢেকে রাখার কথা বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ইহরাম ছাড়া অন্য সময়ে নারী-পুরুষ সবাই স্বাভাবিক কাপড় পরিধান করবেন।

৩. তালবিয়া পাঠ : ইহরাম বাঁধার পর তালবিয়া- লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক... পড়তে হয়। পুরুষরা উচ্চস্বরে তা পড়বে আর নারীরা হালকা আওয়াজে পড়বে। নারীদের উচ্চ আওয়াজে তালবিয়া পড়া নিষেধ।

৪. ইদ্দত পালন : নারী যদি তালাক বা স্বামী মৃত্যুর ইদ্দত পালন করতে থাকে তাহলে নারীরা হজ করতে পারবে না। হজ শুরুর পূর্বে ইদ্দত শেষ হলে হজের জন্য বের হতে পারবে। অন্যথা পরবর্তী বছর হজ করবে।

আরও পড়ুন: দানবাক্স থেকে পাগলা মসজিদের দৈনিক আয় লাখ টাকা!

৫. তাওয়াফ : তাওয়াফ করার ক্ষেত্রে নারীরা যথাসম্ভব পুরুষদের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলবে। নারীদের জন্য আলাদা জায়গার ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয়। অদূর ভবিষ্যতে আলাদা লাইন বা সময় হবার সম্ভাবনা রয়েছে।

তাওয়াফের ক্ষেত্রে পুরুষরা যখন ইজতিবা করবে তখন নারীদের ইজতিবা করার প্রয়োজন নেই। পুরুষরা যখন বীরের মতো হেলেদুলে রমল করে নারীরা তখন স্বাভাবিকভাবে হেঁটে তাওয়াফ করবে।

কাবা শরীফের হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ বা চুম্বনের জন্য পুরুষদের সঙ্গে ঠেলাঠেলি জায়েজ নয়। ভিড় ছাড়া, পুরুষদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি ছাড়া যদি হাজরে আসওয়াদে চুমু দেওয়া যায় তাহলে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। নারীদের জন্য আলাদা সময় করার পরিকল্পনা করছে হারামাইন কর্তৃপক্ষ।

৬. সায়ী অবস্থায় : সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ে সায়ী বা দৌঁড়ানোর আমলটি একজন নারী থেকেই এসেছে। নারীরাও সায়ী করবে তবে দু’সবুজ বাতির এলাকায় দৌঁড়াতে হবে না নারীদের।

৭. হজ অবস্থায় ঋতুস্রাব হলে : নারীরা ঋতুস্রাব চলাকালীন সময়ে তাওয়াফ ছাড়া সব কিছুই করতে পারবে। হজের ফরজ তাওয়াফ বা তাওয়াফে জিয়ারত করার পূর্বে মাসিক শুরু হলে স্রাব বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। স্রাব বন্ধ হবার পর তাওয়াফে জিয়ারত করে যথারীতি হজ শেষ করবে। স্রাব ১২ তারিখের পর বন্ধ হলেও এতে কোনো দম বা জরিমানা দিতে হবে না।

যদি ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার কারণে কিংবা অন্যকোনো কারণে কিছুতেই স্রাব বন্ধ হওয়া পর্যন্ত মক্কায় থাকা সম্ভব না হয়, তাহলে পরবর্তীতে আবার মক্কায় পৌঁছে তাওয়াফ আদায় করতে হবে। তাওয়াফ আদায় না করা পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রীর মিলন বৈধ হবে না। এ ক্ষেত্রে বিকল্প হলো- সেনেটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে তাওয়াফে জিয়ারত আদায় করে নেওয়া। সেক্ষেত্রে দম বা জরিমানা দিতে হবে।

মাসয়ালা : যদি তাওয়াফে জিয়ারত আদায় করার পর স্রাব শুরু হয় তাহলে তার জন্য তাওয়াফে বিদা (বিদায়ী তাওয়াফ) মাফ। তাওয়াফে বিদা ছাড়াই হজ শেষ করতে পারবে। তবে অপেক্ষা করে সুস্থ হবার পর তাওয়াফে বিদা করতে চাইলে তাও করতে পারবে।

মাসয়ালা : হজ অবস্থায় স্রাবের সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য ঔষধ বা ইনজেকশন ব্যবহার করতে চাইলে এর অনুমতি আছে। -জাদিদ ফিকহি মাসায়েল: খালিদ সাইফুল্লাহ রাহমানি, পৃ. ১৯১

লেখক: অধ্যাপক, উর্দু বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

হজ বিষয়ে জানতে আরও পড়ুন

** হজ: আল্লাহপ্রেমিকদের মিলনমেলা

** হিসাব রক্ষক ও ফিল্ড সুপারভাইজার এখন সরকারি হজগাইড!

** শ্রেষ্ঠ আমল হজ, বিনিময়ে জান্নাত

এ সম্পর্কিত আরও খবর