ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি) সামীম মোহাম্মদ আফজালের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ ১ জানুয়ারি শেষ হচ্ছে। বিচার বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এ কর্মকর্তা টানা ১০ বছর ধরে ডিজির দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
শারীরিকভাবে অসুস্থতার পাশাপাশি দুর্নীতি অনিয়মের কারণে ব্যাপকভাবে সমালোচিত। সামীম আফজাল ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি প্রেষণে ইফার ডিজি হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর অবসরকালীন ছুটিতে যাওয়ার কথা ছিলো। তখন ছুটি বাতিল করে ডিজি পদে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। মেয়াদান্তে পুনরায় দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান।
নতুন করে চুক্তির মেয়াদ বাড়বে না কি নতুন মুখ আসছে, সে নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। বিশেষ করে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ইফা ডিজির দূরত্বের কারণে অনেকেই চুক্তি নবায়নের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্প্রতি সংস্থাটির কাজের বিশেষ অডিট (২০০৯-২০১৯) কার্যক্রম পরিচালনা করে। এতে ইফা ডিজির বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহার, অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠে আসে। এর আগে গত জুনে ইফার বোর্ড অব গভর্নরস ডিজিকে মেয়াদের বাকি সময় ছুটিতে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও তাতে ডিজি রাজি না হওয়ায় বোর্ড ডিজির ক্ষমতা খর্ব করে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার অপসারণ চেয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করেন। এসব মিলিয়ে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ কর্মকর্তার মেয়াদ বৃদ্ধির সম্ভাবনা খুবই কম।
ইতোমধ্যেই নতুন মুখের সন্ধান করার খবর ছড়িয়ে পড়েছে। নতুন ডিজি হিসেবে বেশ কয়েকজনের নাম আলোচনায় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে নতুন ডিজি নিয়োগ দেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিয়ম রয়েছে ডিজির পদ শূন্য হলে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে সংস্থার সচিব ভারপ্রাপ্ত ডিজি হিসেবে দায়িত্ব পেতে পারেন। অথবা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সংস্থা) মুহা. আব্দুল হামিদ জমাদ্দারকে সাময়িক দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। জানুয়ারির মাঝামাঝি কিংবা ফেব্রুয়ারি নাগাদ নতুন ডিজি নিয়োগ দেওয়া হতে পারে।
নতুন ডিজির সংক্ষিপ্ত তালিকায় যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন- ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক পরিচালক ও শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ, ইফার পরিচালক মহিউদ্দিন মজুমদার বাদল এবং ইফার সাবেক উপ-পরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ আল মারুফ, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ড. চৌধুরী মো. বাবুল হাসান, ঢাকা ওয়াসার সাবেক ম্যাজিস্ট্রেট বর্তমানে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াসিউদ্দিন ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সংস্থা) মুহা. আব্দুল হামিদ জমাদ্দার।
আব্দুল হামিদ জমাদ্দারকে অনেকটা এগিয়ে রাখছেন কেউ কেউ। কারণ, এর আগে তিনি ইফার মডেল মসজিদ নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বায়তুল মোকাররম মসজিদ ও মার্কেট বিভাগের পরিচালক মহিউদ্দিন মজুমদার বাদলের ডিজি বা ভারপ্রাপ্ত ডিজির দায়িত্ব পাওয়ার বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে। ইফার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে তার বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। বর্তমান ডিজির বিরুদ্ধে আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। ছাত্র অবস্থায় থেকেই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মহিউদ্দিন মজুমদার। ফেনীর এই বাসিন্দা ছাত্রলীগের শামীম-পান্না কমিটিতে সহ-সমাজসেবা সম্পাদক ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় সহ-সম্পাদক হিসেবে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু পরিষদ ইসলামিক ফাউন্ডেশন শাখার আহবায়কের দায়িত্বে রয়েছেন।
শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের নামও ডিজি হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। তবে বয়স বেশি হওয়ার কারণে তার নিয়োগের সম্ভাবনা কম বলে মনে করছেন অনেকে। এ ছাড়া কওমি আলেম-উলামাদের বৃহৎ একটা অংশের সঙ্গে তার মতবিরোধকে নেতিবাচক হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ আল মারুফ নিয়োগ পেতে জোর তদ্বীর চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান ডিজিও তার জন্য সুপারিশ করছেন বলে শোনা যাচ্ছে। ধর্মীয় মতাদর্শের পার্থক্যের কারণে তাকে পিছিয়ে রাখছেন অনেকে। তিনি সারাবিশ্বে একই দিনে ঈদ ও রোজাপালন মতাদর্শের পক্ষপাতী এবং মিলাদ-কিয়ামের পক্ষে। এ কারণে কওমি ও তাবলিগপন্থীদের চরম অপছন্দের তালিকায় রয়েছেন। তাকে এই পদে বসিয়ে আলেম-উলামাদের মাঝে অসন্তোষ তৈরি করার মতো ঝুঁকি সরকার নেবেন বলে সংশ্লিষ্টরা বিশ্বাস করতে চান না।
সংক্ষিপ্ত তালিকায় রয়েছেন ঢাকা ওয়াসার সাবেক ম্যাজিস্ট্রেট বর্তমানে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াসিউদ্দিন। আরেকজন হলেন, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ড. চৌধুরী মো. বাবুল হাসান। গোপালগঞ্জের এই বাসিন্দা বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি ইফা ডিজি হওয়ার দৌঁড়ে নেই। আমি কোনো তদবির কিংবা লবিং করছি না। দায়িত্ব দিলে নেবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, যদি প্রধানমন্ত্রী আমাকে দায়িত্ব দেন, তাহলে সেটা ভিন্ন বিষয়।
নানা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজালের চুক্তির মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না, এটা প্রায় নিশ্চিত। এ প্রেক্ষিতে সম্প্রতি ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে তিন জনের নাম উল্লেখ করে একটি সার-সংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা আসার পর ডিজির নিয়োগ চূড়ান্ত করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
নুতন ডিজি হিসেবে এবার সরকারি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেই কাউকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি শোনা যাচ্ছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কমকে বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের চেইন অব কমাণ্ড ভেঙে গেছে। বর্তমান ডিজির কারণে একটি অকার্যকর সংস্থায় পরিণত হয়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে কাউকে নিয়োগ দেওয়া বেশি জরুরি। আবারও রাজনৈতিক নিয়োগ হলে, বর্তমান ডিজির অনেক কিছু ঢাকা পরে যেতে পারে। ফাউন্ডেশন আর মুখ তুলে দাঁড়াতে পারবে না।
মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজালের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ সব অভিযোগের প্রেক্ষিতে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় ইফায় বিশেষ নিরীক্ষা চালায়। তাতে প্রাথমিকভাবে ১৩২টি আপত্তিতে প্রায় ৯ শ’কোটি টাকা নয়-ছয়ের প্রমাণ মেলে। পরে ইফা ডিজি কয়েক দফায় প্রায় ৭৩ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেন। এরপরও ৯৬টি খাতে দুর্নীতির সুস্পষ্ট প্রমাণ পায় অডিট টিম।