‘যদি তোমরা অভিযানে বের না হও, তবে আল্লাহতায়ালা তোমাদের কঠিন শাস্তি দেবেন এবং তোমাদের স্থলে অন্য কোনো জাতিকে নিয়ে আসবেন। আর তোমরা কিন্তু তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ -সূরা তাওবা: ৩৯
এই আয়াত তাবুক যুদ্ধের পটভূমিতে নাজিল হয়েছে। যুদ্ধের নির্দেশ আসার পরও যারা নানা কারণে পিছিয়ে পড়েছিল, এই আয়াতে তাদের কঠিন শাস্তি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
নবম হিজরি, ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে তাবুক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। স্থানটি মদিনা থেকে ৬৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে আরবের কাফের ও মুনাফিকদের শেষ চেষ্টা। রোমানদের দ্বারা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দূত হারেস বিন উমায়ের (রা.)-কে হত্যার মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। এ যুদ্ধে নবী করিম (সা.) ৩০ হাজার যোদ্ধা সাহাবির এক বাহিনী নিয়ে তাবুক অভিমুখে রওনা হন। এটাই ছিল নবী করিম (সা.)-এর জীবনের সবচেয়ে বড় সেনা অভিযান।
পৃথিবী থেকে ইসলাম নিশ্চিহ্ন করতে রোমানরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে এলেও উভয় পক্ষের মাঝে কোনো লড়াই হয়নি। সম্মুখ লড়াইয়ের আগেই রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস ভীত হয়ে রণাঙ্গন ত্যাগ করেন।
সৌদি আরবের ১৩টি প্রদেশের মধ্যে তাবুক অন্যতম। এলাকাটি আবহাওয়া বৈচিত্র্যে ভরপুর। সৌদি আরবের এই প্রদেশের কিছু অংশে প্রচণ্ড শীতে তুষারপাত দেখা যায়। অনেকে বলেন, মরুর দেশে নিজের চোখে তুষারপাতের নৈসর্গিক দৃশ্য অবলোকন করতে হলে আপনাকে তাবুক যেতে হবে। তবে আমরা তুষারের শুভ্রতা দেখতে পাইনি, আমরা তাবুক যাই; রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে। কিন্তু আমাদের প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি ছিলো না।
তাবুক যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, কারণ, ফলাফল, অংশগ্রহণে অনিচ্ছুকদের শাস্তির বিষয়ে বিশদ বর্ণনা রয়েছে ইসলামের ইতিহাসে। তবে আজকে আমাদের আলোচনা তাবুক অঞ্চল নিয়ে।
মসজিদে তাওবা
স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে মসজিদটি পরিচিত ‘মসজিদুর রাসূল’ হিসেবে। বলা হয়, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাবুক যুদ্ধে একাধারে দশ দিন এ স্থানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছিলেন। তার ওই স্মৃতিকে সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে খলিফা উমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.)-এর সময়কালে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নামাজের স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। যুগে যুগে মসজিদটির প্রয়োজনীয় সংস্কারও করা হয়েছে। মসজিদটির সর্বশেষ সংস্কার করা হয় ১৩৯৩ হিজরিতে।
এই মসজিদের কয়েক হাত দূরে রয়েছে একটি কবরস্থান। সেখানে কয়েকজন সাহাবির কবর রয়েছে। তবে তাদের কারও নাম সংরক্ষণ করা হয়নি।
তাবুক দূর্গ
আব্বাসীয় শাসনামলে দূর্গটি নির্মিত হয়। অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রভাবশালী শাসক সোলায়মান কানুনির সময় মূল অবকাঠামো ঠিক রেখে বৃহৎ পরিসরে সংস্কার করা হয়। কালের বিবর্তনে বিভিন্ন সময়ে সংস্কার হয়ে বর্তমানে দূর্গটিকে জাদুঘর বানানো হয়েছে। সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে তাবুক অঞ্চলের প্রাচীন মানুষের জীবন যাত্রার সঙ্গে সম্পৃক্ত নানা ধরনের শিলালিপি, মুদ্রা, পাত্র এবং যুদ্ধাস্ত্র।
তাবুক জাদুঘর
তাবুক জাদুঘরকে একটি ডিজিটাল জাদুঘর বলা যায়। এর ভেতরে প্রবেশ করতেই একজন আরব যুবক আপনাকে আরবিয় কায়দায় অভ্যর্থনা জানাবে । তবে এই যুবক বাস্তবের কোনো মানুষ নন। এটা ইলেকট্রিক লাইটিংয়ের মাধ্যমে করা হয়েছে। জুাদুঘরের ভেতরে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতাসহ জাজিরাতুল আরবের (আরব উপদ্বীপ) বিভিন্ন সভ্যতার নিদর্শন রয়েছে। বর্তমান ইরাকের প্রাচীন নাম ছিল মেসোপটেমিয়া। জাদুঘরে দেখার রয়েছে শিলালিপি, মানুষের আবক্ষ মূর্তি, প্রস্তর যুগের পাথরের অস্ত্র, হজতর ঈসা (আ.) জন্মের হাজার বছর পূর্বের ব্যবহৃত তৈজসপত্রসহ অনেক কিছু। আপনি ইচ্ছে করলে, এই জাদুঘরে বসে নাবাতী লিপিতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কিছু লেখার সুযোগ নিতে পারেন।
সিকির কূপ
তাবুক দূর্গের পাশে রয়েছে সিকির কূপ। এটাকে আইনে সিকির বা সিকির কূপ বলা হয়। এ কূপের কথা উল্লেখ রয়েছে তাবুক যুদ্ধের ইতিহাসের পরতে পরতে। এ প্রসঙ্গে সহিহ মুসলিমে ইরশাদ হয়েছে, হজরত মোয়াজ বিন জাবাল (রা.) বলেন, তাবুক যুদ্ধের বছর আমরা হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে যুদ্ধে বের হলাম। এ সফরে নবী করিম (সা.) নামাজ একসঙ্গে আদায় করতেন। অর্থাৎ জোহর-আসর একসঙ্গে, আর মাগরিব-এশা একসঙ্গে। একদিন এমন হলো যে, নামাজ দেরিতে আদায় করলেন। তারপর বের হয়ে এসে জোহর ও আসর একসঙ্গে আদায় করলেন, তারপর তাঁবুতে প্রবেশ করলেন। অতঃপর আবার বেরিয়ে এলেন এবং মাগরিব ও এশা একসঙ্গে আদায় করলেন। অতঃপর বললেন, ইনশাআল্লাহ তোমরা আগামীকাল তাবুক জলাশয়ে পৌঁছবে। তবে চাশতের সময় না হওয়া পর্যন্ত তোমরা সেখানে পৌঁছতে পারবে না। তোমাদের মাঝে যে সেখানে প্রথমে পৌঁছবে সে যেন তার পানির কিছুই স্পর্শ না করে, যতক্ষণ না আমি এসে পৌঁছি। আমরা ঠিক সময়েই সেখানে পৌঁছলাম। আমাদের আগে দু’জন লোক সেখানে পৌঁছেছিল। আর প্রসবণটিতে জুতার ফিতার ন্যায় ক্ষীণধারায় সামান্য পানি বের হচ্ছিল। হজরত মোয়াজ (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই দু’জনকে প্রশ্ন করলেন, তোমরা তা হতে কিছু পানি ছুঁয়েছো কি? ... তারা উভয়ে বলল, হ্যাঁ। তখন নবী করিম (সা.) তাদের দু’জনকে ভৎর্সনা করলেন।
বর্ণনাকারী বলেন, এরপর লোকেরা তাদের হাত দিয়ে অঞ্জলি ভরে ভরে প্রসবণ হতে অল্প অল্প করে পানি তুললো, পরিশেষে তা একটি পাত্রে কিছু পরিমাণ জমা হলো। বর্ণনাকারী বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মাঝে তার দু'হাত এবং মুখ ধৌত করেন এবং ওই পানি উল্টে প্রসবনে ঢেলে দেন। ফলে পানির প্রসবণটি প্রবল পানি ধারায় কিংবা বর্ণনাকারী বলেছেন, অধিক পরিমাণে প্রবাহিত হতে লাগলো।
পরে নবী করিম (সা.) বললেন, হে মোয়াজ! তুমি যদি দীর্ঘায়ু হও, তবে আশা করা যায় যে; তুমি দেখতে পাবে প্রসবণের এ জায়গাটি বাগানে ভরে গেছে।
ঐতিহাসিকরা বলেন, হাদিসে যেটিকে আইনে তাবুক বা তাবুক জলাশয় বলা হয়েছে সেটিই হলো- আইনে সিকির বা তাবুক কূপ।
মাদায়েন শোয়াইব
এখানে পাহাড় খোদাই করে নির্মিত ঘরগুলোর সঙ্গে বেশ মিল রয়েছে আল উলা শহরে অবস্থিত মাদায়ের সালেহের ঘরগুলোর।
লোহিত সাগর
আফ্রিকা থেকে এশিয়া মহাদেশকে বিভক্ত করেছে এই লোহিত সাগর। লোহিত সাগরের বুক চিরে এক সময় সাহাবায়ে কেরাম হিজরত করেছিলেন হাবশা তথা বর্তমান ইথিউপিয়ায়। লোহিত সাগরের নীল জলরাশি আপনাকে মনে করিয়ে দেবে বাংলাদেশের সেন্টমার্টিনের কথা। কিন্তু লোহিত সাগর ভিন্ন নানা কারণে। সে ইতিহাস আরেকদিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মদিনা, সৌদি আরব