মানুষ এক স্বাধীন ও যাচাই ক্ষমতাসম্পন্ন অস্তিত্ব। অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির মাধ্যমে সে বিভিন্ন কাজকে বিচার-বিশ্লেষণ করে গ্রহণ ও বর্জন করতে পারে। যেহেতু মানুষ ধীশক্তির অধিকারী, সেহেতু সে ভালোকে মন্দ থেকে পৃথক করতে পারে। অনুরূপ সে স্বাধীন ও নির্বাচন ক্ষমতার অধিকারী। ফলে সে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে।
যেহেতু মানুষ বুদ্ধিবৃত্তির আলোয় উদ্ভাসিত, সেহেতু সে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ অস্তিত্বরূপে পরিগণিত। এ জন্য তার কিছু কর্তব্য ও দায়িত্ব রয়েছে। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে মানুষের এ দায়িত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত হয়েছে। হাদিসেও হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং প্রত্যেকের নিকট তার দায়িত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।
এই দায়িত্ববোধ থেকে প্রশ্ন জাগে, আমরা কী আমাদের দায়িত্ব পালন করছি? মানুষের পূর্ণতার জন্য শ্রেষ্ঠত্বের যে মানদণ্ড তা কী রক্ষা করছি? সঙ্গত কারণেই বলা চলে, আমরা কি সত্যিকারের মানুষ হতে পারি না?
হতাশা থেকে নয়, আশাবাদ থেকে এমন উচ্চারণ। বস্তুত মানুষ হওয়া সহজ, যদি আমরা মানুষ হতে চাই। শরীর আছে বলেইতো মানুষ ক্ষুধার্ত হয়, মন আছে বলেইতো মানুষ অনুভব করে, আরও উন্নত স্তরের আলোয় উদ্ভাসিত হয় মানুষের আত্মা। এই শরীর, মন, আত্মা নিয়েইতো মানুষ। এই তিনটি বিষয়ের সামঞ্জস্য বিকাশ ঘটলেই মানুষ হয়ে ওঠে কাঙ্ক্ষিত মানুষ।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- কয়টি পরিবারে, কতটি সমাজে, কোন কোন দেশে নাগরিকদের কাঙ্ক্ষিত মানুষ হিসেবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ ও আয়োজন আছে? তাই প্রশ্ন জাগে, এই যে আমরা মানুষ হয়ে উঠতে আপছি না এর দায়টা কার?
ব্লেমগেমের এই যুগে আমরা নিজের দায়িত্ব ও দায় মুহূর্তেই যে কারও ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারি। কিন্তু তাতে মানুষ হওয়ার লক্ষ্য অর্জিত হবে কী?
পৃথিবীতে সব মানুষ এক রকম নয়। রয়েছে ধর্ম, বর্ণ, বিশ্বাস ও ভাষার নানা বৈচিত্র্য। এই বিষয়গুলোকে অবলোকন করে দার্শনিক ভাবনায় বিদগ্ধজনরা উচ্চারণ করেছিলেন বৈচিত্র্যের ঐক্যের কথা। কিন্তু বৈচিত্র্যের ঐক্য সৃষ্টি হবে কেমন করে? আমরা নিজকে, নিজের ধর্ম-দর্শনকে কতটা জানি? জানতে গিয়েতো আমরা বারবার হোঁচট খাই। আমরা যদি নিজেদের ধর্ম-দর্শনকে মোটামুটিভাবেও জানতে পারতাম, তাহলে আমাদের চারপাশে আমাদের কাজগুলোর প্রতিফলন দেখতে পেতাম। কিন্তু তেমনটা আমরা দেখছি না। এই না দেখাটা সমাজের জন্য একটা অশনি সংকেত।
তাহলে এটা বলা বোধহয় বেশি হবে না যে, মানুষ হিসেবে আবার নিজেদের ধর্ম-দর্শনের পুনঃপাঠ প্রয়োজন। যে ধর্ম-দর্শন মানুষের শরীর-মন-আত্মা নিয়ে কথা বলে। কথা বলে সমাজ-সংগঠন এবং রাষ্ট্র নিয়ে। ধর্ম-দর্শনে চিন্তার পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু তার অর্থ এই নয়, এক ধর্ম-দর্শনের মানুষ অন্য ধর্ম-দর্শনের শাসন-প্রশাসনে সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকতে পারবে না।
আমরা জানি, ধর্ম-দর্শনের ধারক-বাহকরা শুধু জ্ঞানে-গুনে সমৃদ্ধ নন, প্রতিপক্ষের প্রতি আচরণেও তারা ছিলেন উদার। তাই তারা মানবজাতিকে দিয়ে গেছেন ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ বার্তা।
মদিনার কল্যাণ রাষ্ট্রে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাঁকির বদলে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ন্যায়ের চেতনা। সেখানে ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক, মুসলিম সবাই নিজ নিজ ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এক রাষ্ট্রের অধীনে। সবাই সেখানে ভোগ করেছিল সমান অধিকার।
যেকোনো ধর্মই মানুষকে ভালো মানুষ হতে অনুপ্রাণিত করে। ভালো মানুষ হতে হলে শরীর, মন ও আত্মার যথাযথ বিকাশের দিকে মনোযোগী হওয়া দরকার। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কেউ এই দায়িত্বে গাফেল থাকতে পারে না। আর ব্যক্তি ও ধর্ম প্রচারকদের দায়িত্ব এক্ষেত্রে আরও মৌলিক।
ইসলামে ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অন্যান্য স্বাধীনতা, আধ্যাত্মিকতা উৎকর্ষের সঙ্গে বিরোধ না থাকা এবং সামাজিক কল্যাণকে ব্যাহত না করার শর্তাধীন। প্রকৃতপক্ষে ইসলামে (আদেশ-নিষেধের ক্ষেত্রে) দর্শন হলো, মানুষকে দায়িত্ব প্রদান করে তার সত্তাগত মর্যাদা রক্ষা করা এবং সামাজিক কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধান করা।
এক হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি গোপনে কোনো পাপাচারে লিপ্ত হয়, সে কেবল নিজেরই ক্ষতি করে। কিন্তু যদি প্রকাশ্যে গোনাহে লিপ্ত হয় এবং কোনো প্রকার বাধার সম্মুখীন না হয় তবে সে সমাজের ক্ষতি করে।
কোনো জাতির অগ্রগতি বা পশ্চাদপদতার উৎস হিসেবে বাহ্যিক কারণগুলোর কথা বাদ দিলে তা মূলত তাদের বিশ্বাস, আচরণ ও চারিত্রিক বিষয়ের মূলে নিহিত। যে সমাজ ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচারের ভিত্তিতে তাদের সামাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে, সে সমাজ সুন্দর ও আরামদায়ক জীবনের অধিকারী হবে। আর যে জাতি এর ব্যতিক্রম কোনো সামাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে, সে জাতির ভবিষ্যত হবে এক নিদারুণ হতাশাব্যঞ্জক। মনে রাখতে হবে, ভবিষ্যতে সত্য-মিথ্যার অবিরাম সংঘর্ষের আবর্তে চূড়ান্ত বিজয় হবে সত্যের। সুতরাং সেভাবেই যাবতীয় কর্মপন্থা নির্ধারণ করে পথ চলতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।