‘দুনিয়ায় বিচরণকারী এমন কোনো প্রাণী নেই, যার রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর নেই। তাদের স্থায়ী এবং অস্থায়ী অবস্থানস্থল সম্পর্কে তিনি অবহিত। সবকিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লেখা আছে।’ -সূরা হুদ: ৬
এ আয়াতে আল্লাহতায়ালা সকল প্রাণীর রিজিক তার যে তার জিম্মায় রয়েছে সে কথা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন। সমগ্র পৃথিবীর জলে-স্থলে, গাছ-গাছালিতে, গুহায় এবং গর্তে যত স্থান হতে পারে এবং যত স্থানে প্রাণী থাকতে পারে, তাদের সবার আহার ব্যবস্থা একমাত্র আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে। কোন জীব কোথায় থাকে, কোথায় চলাচল করে, কোথায় আশ্রয় গ্রহণ করে, কোথায় মৃত্যুবরণ করে, মায়ের উদরে কী থাকে সব কিছুই মহান আল্লাহর কিতাবে লেখা রয়েছে। -তাফসির ইবনে কাসির
রিজিক এমন জিনিস, যা আল্লাহতায়ালা প্রাণিকুলের নিকট নিয়ে যান এবং প্রাণীরা তা আহার করে। এ রিজিক অনেক ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন- স্বাস্থ্য, সম্পদ, খাদ্য, বুদ্ধি, উপায়-উপকরণ ও সময় ইত্যাদি। এমনকি আমাদের জীবনটাও একটা রিজিক। এই সবকিছু আল্লাহতায়ালা আমাদের দিয়েছেন।
মুসলিম হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ হলেন- রিজিকদাতা। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা যদি একবারে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকি, তাহলে আমাদের সামনে রিজিক আসবে না চেষ্টা করতে হবে? অবশ্যই খাবারের সন্ধানে চেষ্টা করতে হবে। শুধু তাই নয়, এ রিজিক বৃদ্ধি জন্য চেষ্টা-তদবির করা, আমল করা, সর্বোপরি মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করা একান্ত কর্তব্য।
আল্লাহতায়ালা রিজিক অন্বেষণের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, ‘তারপর যখন নামাজ শেষ হয়ে যায়, তখন ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো এবং অধিক মাত্রায় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো। আশা করা যায়, তোমরা সফলকাম হবে। -সূরা আল জুমুআ: ১০
অধিকাংশ কাজ যার মাধ্যমে রিজিক অর্জন করা যায়, তা আল্লাহতায়ালা সহজ করেছেন, কঠিন করেননি। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তিনিই তো সেই মহান সত্তা যিনি ভূপৃষ্ঠকে তোমাদের জন্য অনুগত করে দিয়েছেন। তোমরা এর বুকের ওপর চলাফেরা করো এবং আল্লাহর দেওয়া রিজিক খাও। আবার জীবিত হয়ে তোমাদেরকে তার কাছেই ফিরে যেতে হবে।’ -সূরা আল মুলক: ১৫
এই আয়াতে একটি কথা স্পষ্ট করা হয়েছে, দুনিয়াতে জীবন পরিচালনার জন্য যত কিছুই করা হোক না কেন, এ দুনিয়া শেষ ঠিকানা নয়। যত উপার্জন হোক না কেন, তা স্থায়ী কোনো সম্পদ নয়। সকলকে অবশ্যই একদিন এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। সেদিন প্রত্যেক ব্যক্তিকে অবশ্যই তার উপার্জন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। আল্লাহর সামনে হিসাব দিতে হবে কোন স্থান থেকে থেকে উপার্জন করলে এবং কোথায় ব্যয় করলে। এ সম্পর্কে কোরআন-হাদিসে প্রচুর বর্ণনা রয়েছে।
মনে রাখতে হবে রিজিকের সন্ধান, রিজিকের জন্য পরিশ্রম খারাপ কোনো কাজ নয়। শুধু রিজিকের মাধ্যমগুলো হতে হবে বৈধ। রিজিকের চেষ্টার পাশাপাশি আর যে সব আমল করা যায় তা হচ্ছে-
-মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা ও খোদাভীতি অবলম্বন করা।
-কৃতকর্মের জন্য তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা।
-আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ ভরসা করা।
-আল্লাহর ইবাদতে গভীর মনোনিবেশ করা।
-আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা।
-আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করা।
-আল্লাহর পথে হিজরত করার মাধ্যমে রিজিক বেড়ে যায়।
-দুর্বল ও অসহায় মানুষের প্রতি মমতা দেখানো।
-দ্বীনি ইলম অন্বেষণে আত্মনিয়োগকারীর জন্য ব্যয় করা।
-হজ ও উমরার পারস্পরিকতা তথা হজ ও উমরা পরপর আদায় করা।
রিজিক অন্বেষণের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকভাবে পরিত্যাজ্য কিছু বিষয় রয়েছে। সেগুলো পরিত্যাগ করতে না পারলে রিজিক হারাম হয়ে যাবে। যেমন-
-উপার্জন সামান্যতম হারামের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও তা পরিত্যাগ করা।
-ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য পরিধেয় বস্ত্রসহ সবকিছু হালাল উপার্জন দ্বারা হওয়া, অন্যথায় তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
-মিথ্যাচার ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণের মাধ্যমে সম্পদ অর্জন না করা।
-সুদের সঙ্গে কোনো অবস্থাতে সম্পৃক্ততা না থাকা। এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা খুব শক্তভাবে সতর্ক করেছেন।
-জুলুম একটি সর্বাধিক নিন্দনীয় অপরাধ, যা শক্তিমান মানুষ করে থাকে আর দুর্বল ব্যক্তি নীরবে তা সহ্য করে এবং আল্লাহর নিকট বিচার পেশ করে। জুলুমের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হওয়ার কারণে ইসলামে যেকোনো ধরনের জুলুম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ পন্থায় চলা কোনো ব্যক্তি আখেরাতে একেবারে রিক্তহস্ত হয়ে যাবে। সুতরাং এ পথে সম্পদ অর্জন একেবারে চিরতরে পরিত্যাগ করতে হবে।
-অপচয় ও অপব্যয় না করা। ব্যবসা-বাণিজ্য ও সম্পদ অর্জন করার ক্ষেত্রে অবশ্যই যে কোনো ধরনের অপচয় ও অপব্যয় করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
-ঘুষের সম্পৃক্ততা না থাকা। ঘুষ দেওয়া-নেওয়া বা এর সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা রাখলে সে উপার্জন সরাসরি হারাম হয়ে যাবে।
-অন্যের অধিকার নষ্ট না করা। অন্যের হক বঞ্চিত করার মাধ্যমে যে উপার্জন করা হয় তা অবৈধ। তাই সকল প্রকার খেয়ানত থেকে বিরত থাকতে হবে।
বর্ণিত আয়াতের শিক্ষা
-মানব মনে যত প্রকার চাহিদার উদয় হয়, সর্বাবস্থায় তা আল্লাহর দরবারে পেশ করা।
-যে কোনো ধরনের রিজিক একমাত্র মহান রবের কাছে যাচনা করা।
-কোনো প্রয়োজন পূরণ হতে দেরি হলেও ধৈর্যধারণ করতে হবে। কোনো ধরনের শিরক, বিদআতের আশ্রয় গ্রহণ করা যাবে না।
-সর্বাবস্থায় হালাল রিজিক- যত কঠিন হোক, আহরণ করতে হবে। হারাম রিজিক- যত সহজ হোক, পরিত্যাগ করতে হবে।
-সর্বাবস্থায় আল্লাহর রহমতের অপেক্ষা করা এবং তার সাহায্যের মাধ্যমেই সব সমস্যা সমাধানের জন্য দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ হওয়া।