‘তোমরা স্বীয় পালনকর্তাকে ডাকো কাকুতি-মিনতি করে এবং সংগোপনে, তিনি সীমা অতিক্রমকারীদের পছন্দ করেন না।’ –সূরা আরাফ: ৫৫
আরবি দোয়া শব্দের একদম সরল অর্থ ডাকা, আহ্বান করা। সাধারণভাবে দোয়া বলতে বুঝায়, আল্লাহতায়ালার কাছে চাওয়া। কোরআন-হাদিসের বহু জায়গায় ইবাদত অর্থে দোয়া শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়। কবুল করা অর্থ দেয় এমন একটি আয়াতের পূর্বে দোয়া শব্দ এসেছে, সেখানও ইবাদত অর্থ নিয়েছেন একদল প্রাজ্ঞ তাফসিরবিদ। তাফসিরে জালালাইনে সূরা আল মুমিনের ৬০ নম্বর আয়াতে ‘উদঊনি আসতাজিব লাকুম’ (তোমরা আমাকে ডাকো, আমি সাড়া দেবো)-এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে আরবিতে ‘উবুদুনি উসিবকুম’ অর্থাৎ আমার ইবাদত করো- আমি সওয়াব দেবো। এ জন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, দোয়া হলো- ইবাদত।
দোয়া কিভাবে করব
আমরা আল্লাহতায়ালার কাছে চাই আর তার ইবাদত করি। তা কিভাবে করবো। তার নির্দেশনাও আল্লাহতায়ালা দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, কাকুতি-মিনতিভাবে অতি সঙ্গোপনে দোয়া করতে। তিনি আবার সাবধানও করে দিয়েছেন, দোয়াতে সীমারেখা অতিক্রম না করতে। বলেছেন, সীমা লঙ্ঘনকারীরা তার পছন্দের নয়। যারা অপছন্দের মানুষ হয়, তারা কাজের পুরস্কার পাওয়া দূরে থাক, তিরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রবল।
দোয়ায় সীমা লঙ্ঘন!
দোয়ায় সীমা লঙ্ঘনের একটি দিক হলো- উচ্চস্বরে দোয়া করো। সূরা আরাফের ৫৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা তাবারি ইবনে জুরাইজের বরাতে বলেন, আয়াতটিতে সীমা লঙ্ঘন বলতে ইঙ্গিত করা হয়েছে উচ্চস্বরে দোয়া করার প্রতি। উম্মত জননী হজরত আয়েশা (রা.)-এর সূত্রে এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, সূরা ইসরার ১১০ নং আয়াতটি দোয়ার ব্যাপারে নাজিল হয়। তাতে ইরশাদ হয়েছে, স্বর উঁচু করো না এবং অতিশয় ক্ষীণও করো না। এ দু’য়ের মাঝপথ অবলম্বন করো। ক্ষীণ না করার অর্থ মনে মনে কল্পনা না করে মুখে উচ্চারণ করা। হজরত আবু মুসা আল আশআরি (রা.) বলেন, কোনো এক সফরে আমরা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। লোকজন উচ্চস্বরে তাকবির বলতে লাগল। নবী করিম (সা.) বললেন, হে লোক সকল! থামুন, নিজেদের ওপর করুণা করুন। আপনারা কোনো বধির এবং অনুপস্থিত কাউকে ডাকছেন না। আপনারা যাকে ডাকছেন, তিনি শ্রবণশীল নিকটবর্তী। তিনি আপনাদের সঙ্গেই আছেন। -সহিহ মুসলিম: ৫০০২
এ হাদিসের আলোকে বিখ্যাত তাবেয়ি হজরত হাসান বসরি (রহ.) বলেন, উচ্চস্বরে দোয়া করা বিদআত।
উল্লেখ্য, কিছু কিছু জিকির ও ইবাদত উচ্চস্বরে করার কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। যেমন- হজের তালবিয়া, তাকবিরে তাশরিক ইত্যাদি। এগুলো যেভাবে বর্ণিত হয়েছে সেভাবে আদায় করাই হলো- সুন্নত।
সংক্ষিপ্ত অর্থপূর্ণ বাক্যে দোয়া
আম্মাজান হজরত আয়েশা (রা.) হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দোয়ার বাক্যগুলো সম্পর্কে বলেন, নবী করিম (সা.) অর্থপূর্ণ বাক্যে দোয়া করা পছন্দ করতেন আর বাহুল্য পরিহার করতেন। -সুনানে আবু দাউদ: ১৪৮২
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বেশিরভাগ সময় এভাবে দোয়া করতেন, ওহে আমাদের রব! ইহকালে আমাদেরকে কল্যাণ দাও, পরকালেও আমাদেরকে কল্যাণ দাও। জাহান্নামের শাস্তি থেকে আমাদেরকে পরিত্রাণ দাও। -সহিহ বোখারি: ৬৩৪৯
আম্মাজান হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, একদা আমি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি লাইলাতুল কদর পেয়ে যাই তাহলে কিভাবে দোয়া করব? তিনি বললেন, তুমি এভাবে দোয়া করো, হে আল্লাহ! তুমি নিশ্চয়ই মার্জনাকারী। মার্জনা করা তোমার পছন্দ। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করো। -সুনানে তিরমিজি: ৪৪২৩
হজরত সাদ ইবনে ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি তার এক ছেলেকে দোয়া করতে শুনলেন, সে দোয়ায় বলছে, ওহে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে জান্নাতের নিয়ামতরাজি ও এর চাকচিক্যতা ইত্যাদি ইত্যাদি প্রার্থনা করছি। তিনি তখন বললেন, হে বৎস! আমি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলছিলেন, অচিরেই এমন একদল লোকের আবির্ভাব হবে; যারা দোয়া করার সময় অতিরঞ্জন করবে। সাবধান! তুমি তাদের দলভুক্ত হবে না।’ –সুনানে আবু দাউদ: ১৪৮০
অন্য নবীদের দোয়া
কোরআনে কারিমে পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের দোয়া উদ্ধৃত হয়েছে। হজরত আদম (আ.) থেকে হজরত ঈসা (আ.) পর্যন্ত সকল নবীর দোয়াতেই শিক্ষা রয়েছে আমাদের জন্য। শিক্ষণীয় দোয়াগুলোই আল্লাহতায়াআলা কোরআনে কারিমে ইরশাদ করেছেন। বিশাল বিশাল পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে নবীগণ আল্লাহতায়ালার রহমত হতে নিরাশ হননি। বরং মনিবের (আল্লাহ) দরবারে অধিকতর বিনয়াবনত হয়েছিলেন। ঘনীভূত বিপদে দৃঢ়ভাবে তাদের আনুগত্য প্রকাশ পেত। তাদের হৃদয়ের গহীন থেকে বেরিয়ে আসত অল্পকথার মর্মস্পর্শী দোয়াসমূহ।
আমাদের দোয়া
আমরা দোয়া বলতে বুঝি কোনো ধরনের অনুষ্ঠান। হোক না তা স্বল্প পরিসরে। লম্বা করে কিছু না বললে, দোয়া হয়েছে বলে আমরা মনে করি না। আমাদের অন্তরে শান্তি আসে না। আমরা বিশেষ দোয়ার আয়োজন করি। এজন্য দাওআত দিয়ে লোক জড়ো করি। দোয়া পরিচালনা করার জন্য অন্য কারও দ্বারস্থ হই। এসব আমরা কোথা থেকে পেলাম?
হজ ফেরত ব্যক্তিদের কাছে দোয়া চাওয়া সুন্নত। এভাবে যে কারও কাছে দোয়া চাওয়া যেতে পারে। তিনি তাৎক্ষণিক তার জন্য দোয়া করবেন। আমি সদ্য ফেরা এক হাজির কাছে দোয়া চাইলাম। তিনি হাত উঠিয়ে বিশাল এক দোয়া শুরু করে দিলেন। কোনো কোনো সময় নবী করিম (সা.) কাউকে জিজ্ঞেস করতেন, তোমার জন্য কি দোয়া করব। সে যা চাইত তিনি ভালো মনে করলে সেভাবে তার জন্য দোয়া করে দিতেন। রাহমাতুল্লিল আলামিন নিজ থেকেও কোনো কোনো সময় কারও জন্য দোয়া করে দিতেন।
দোয়ার অভিনয়
দোয়ার অভিনয় করতে দেখা যায় অনেককে। আবেগময় কথা দিয়ে মানুষের হৃদয় গলানোর কসরত করেন অনেকে। আমরা দোয়ায় প্রথমে আরবি পরে নিজ ভাষায় একই কথা আওড়াতে থাকি। কেউ কেউ আবার মাঝে মাঝে উর্দু-ফারসি কবিতা সুর দিয়ে আবৃত্তি করি। এসব কেন করা হয়- আল্লাহ ভালো জানেন।
নামাজের মাঝে যেসব দোয়া রয়েছে- সেগুলোর প্রতি খেয়াল নেই। যারা অর্থ বুঝে না তাদের কথা বাদই দিলাম, যারা বুঝে তাদেরও একই হাল। ফলে সালাম ফেরানোর পর পর মোনাজাতের নামে আবার দোয়া করি। জুমার খুতবায় দোয়ার পর, নামাজের পর আবার দীর্ঘ দোয়া। ভাবটা এমন যেন আগেরগুলো কিছুই হয়নি, এটিই মূল দোয়া। প্রচার করে দেওয়া হলো- মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ কামনায় বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।
টিভির পর্দায় দোয়া অনুষ্ঠান
সেদিন দেখলাম ‘শবে বরাত’ উপলক্ষে টিভির পর্দায় দোয়া অনুষ্ঠান। একটি চ্যানেলে ঘোষণা দিয়ে লাইভ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দোয়ার আয়োজন করা হলো। দোয়াকারী বললেন, দোয়া হলো- ইবাদত। আমাদের কথা হলো- দোয়া ইবাদত হলে তা একান্তভাবে হওয়ার কথা, লাইভে এসে কেন? আক্ষেপ লাগে জানার মতো মানসম্পন্ন ব্যক্তিরা যখন জাগতিক কোনো সুবিধা লাভের আশায় এসব করেন। লাইলাতুল কদরে যেখানে নবী করিম (সা.) তার স্ত্রীকে আল্লাহর রাসূল সংক্ষিপ্ত একটি দোয়া শেখালেন। সেখানে আধা ঘন্টা দোয়ার নামে যা করা হলো- তা বাহুল্য ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। দোয়া একটি ইবাদত বিশেষ, এটা কোনো বিনোদন নয়।
সূরা কাহাফের শেষ আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার রবের সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন নেক আমল করে ও তার রবের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে।’ তাসফিরকারকদের মতে, এখানে ইবাদতে শরিক করা বলতে রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদত উদ্দেশ্য।
লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস ও ভিজিটিং ইমাম নিউ ইয়র্ক ঈদগাহ।