চলমান মহামারির কঠিন পরিস্থিতিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষিকারা অত্যন্ত শোচনীয় জীবন যাপন করছেন। এই কঠিন সময়ে নবীর ওয়ারিস আলেম-উলামাদের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ববোধ থেকে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া (বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড)-এর সভাপতি আল্লামা আহমদ শফীর নির্দেশে একটি কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়েছে। বেফাকের গঠিত ওই কল্যাণ তহবিল থেকে করোনাকালে আর্থিক সঙ্কটে থাকা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সহযোগিতা করা হবে।
সম্প্রতি আল্লামা আহমদ শফী বেফাকের গঠিত কল্যাণ তহবিলে সহযোগিতার জন্য দেশের বিত্তশালী ও দ্বীন-দরদীদের প্রতি উদাত্ত আহবানও জানিয়েছেন। এর আগে সংস্থাটির মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুসও বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কল্যাণ তহবিলে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
করোনাভাইরাসের দরুণ উদ্ভূত পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করায় আকস্মিকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয় দেশের সব কওমি মাদরাসা। বন্ধের শুরুতে পরিস্থিতি সেভাবে অনুধাবন করা যায়নি, ফলে অনেক শিক্ষক বেতন ছাড়া বাড়ি চলে যান। আবার অনেক মাদরাসা কর্তৃপক্ষ সংস্থান না থাকায় বেতন পরিশোধ করতে পারেননি। এমতাবস্থায় বিপুল সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষিকাকে আর্থিক সঙ্কটে পড়তে হয়েছে। অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এ সঙ্কটাপন্ন সময়ে বেফাকের এমন উদ্যোগ অবশ্যই সময়োচিত ও প্রশংসার দাবি রাখে।
বেফাকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সঙ্কটাপন্ন এ সময়ে শিক্ষকদের পাশে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বেফাক তার নিজস্ব অর্থখাত ও জনসাধারণের সহযোগিতা নেবে। সাহায্যপ্রার্থীর তালিকায় প্রাধান্য পাবেন যথাক্রমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কওমি মাদরাসার অসচ্ছল শিক্ষক-শিক্ষিকা, পর্যায়ক্রমে জেলাভিত্তিক মাদরাসাসমূহের অসচ্ছল শিক্ষক-শিক্ষিকা। এ লক্ষ্যে তহবিল সংগ্রহ ও জেলাভিত্তিক মাদরাসার শিক্ষকদের তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে।
এখানেই দেখা দিয়েছে জটিলতা। বেফাকের অনুদান প্রক্রিয়া কিংবা তালিকাজনিত কর্মযজ্ঞ আরও সুন্দর হতে পারতো। বেফাক অনুদান দিতে যাচ্ছে শিক্ষককে। এ জন্য একটি ‘অনুদান ফরম (শিক্ষক)’ ফরম পূরণ করতে হচ্ছে। কিন্তু ফরমের নিচে লেখা, ‘মাদরাসা কর্তৃপক্ষ চাইলে বেফাক প্রদত্ত অনুদানকে বেতনের সাথে সমন্বয় করতে পারবে’- এতে আবার বুঝা যাচ্ছে বেফাক অনুদান মাদরাসাকে দিতে যাচ্ছে।
বাস্তবে দ্বিতীয়টাই হবে তা খুবই সহজ কথা। কেননা, সমন্বয়ের সুযোগ থাকতে কোনো মুহতামিমই সমন্বয় করতে বাদ রাখবেন না। টাকা বলে কথা। ইতোমধ্যে অনেক মুহতামিম এটাকে মাদরাসার অনুদান হিসেবে মনে করে অনিয়মও করা শুরু করেছেন। মাদরাসার নিয়মিত শিক্ষকের সংখ্যা বাড়িয়ে ভাই-বন্ধু, ছেলে-জামাইসহ অন্যদের নাম যুক্ত করে দিয়েছেন। অনেকে প্রাপ্য বেতনের প্রকৃত তথ্য লুকিয়ে পরিমাণে বেশি লিখছেন। এসব বিষয় খতিয়ে দেখার অনুরোধ রইলো।
আমাদের কথা হলো- অনুদান যখন মাদরাসাকেই দেবে তাহলে শিক্ষকদের ব্যক্তিগত তথ্য নেওয়ার অপ্রয়োজনীয় ঝামেলা সৃষ্টি করার কী দরকার ছিল বেফাকের? শিক্ষকদের ব্যক্তিগত তথ্য না নিয়ে মাদরাসার আয়-ব্যয়, বকেয়া, বর্তমান তহবিল, সম্পদের পরিমাণ, স্টাফ সংখ্যা, মাসিক স্টাফ বেতন ইত্যাদি তথ্য এবং বিগত কয়েক বছরের অডিট রিপোর্টের কপি নিয়ে মাদরাসার নামে অনুদান পাঠিয়ে দিত এবং অনুদানের রশিদ জমা নিত। এতে পুরো কাজ অনেক সহজ হতো, স্বচ্ছ হতো।
কিন্তু তা না করে যে প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে অর্থাৎ শিক্ষকের নামে বরাদ্দ হবে, জেলা কমিটি শিক্ষকের প্রাপ্তি নিশ্চিত করবে আবার মুহতামিম তা বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করবে। এতে অনুদান বেফাকের নামে রশিদ মূলে মাদরাসার তহবিলে জমা হবে না, কিন্তু অনুদান পরিমান টাকা বেতন নামে ভাউচার হবে। ফলে কমিটি ও শিক্ষকদের অসচেতনতা কিংবা অসতর্কতায় সবার আড়ালে অনুদান চলে যাবে মুহতামিমের পকেটে।
গৃহীত পদ্ধতির আরেকটি অসুবিধা হলো- এখন লকডাউন চলছে। গণপরিবহন বন্ধ আবার মাদরাসার অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকারা দূর-দূরান্তের। এগুলো সবারই জানা, বেফাক কর্তৃপক্ষও জানেন। তাহলে ফরমে শিক্ষকদের স্বাক্ষরের আবশ্যিক কলাম কেন? কিভাবে দূর থেকে এসে শিক্ষকরা স্বাক্ষর করবেন। আবার স্বাক্ষর আবশ্যিক হওয়ায় স্বাক্ষর নামে কিছু একটা আঁকিবুঁকি তো কাগজে হয়েছেই; তা যেই করুক। কাজটা কি অন্যায় নয়? অনৈতিক নয়? অবৈধ নয়? এখন এ অন্যায় কে করলো, কে করালো, কাকে দিয়ে করালো? এ বিষয়ে আর বিস্তারিত না বলাই ভালো।
উদ্ভূত বিষয়ে মোটা দাগের দুটি সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ১. সিস্টেমের ফাঁক গলে অনুদান চলে যাবে অন্যত্র, ২. জাল স্বাক্ষরের পদ্ধতি চালু হলো।
দ্বিতীয় সমস্যার দৃশ্যায়ন আমরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখেছি। এখন আর এটা সমাধানের কোনো পথ নেই। আর প্রথমোক্ত সমস্যা এখনও দৃশ্যমান হয়নি- তবে হবে। এখানে সমাধানের পথ এখনও রয়েছে। হয়তো বেতনের সঙ্গে অনুদানের টাকা সমন্বয়ের সুযোগ বাতিল করা। অথবা বরাদ্দ শিক্ষকের নামে না দিয়ে মাদরাসার নামে বরাদ্দ দিয়ে মাদরাসা থেকে মানি রিসিট নেওয়া।
তবে সবচেয়ে ভালো হয়, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সহায়তা দিলে সেটা সরাসরি শিক্ষকের হাতে কিংবা বিকাশ, নগদ, রকেট ও ব্যাংক একাউন্টে দিয়ে দেওয়া।
মুফতি মাহফূযুল হক: কওমি মাদরাসার শিক্ষক ও লেখক।