শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন, ঐতিহাসিক মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের অনুপ্রেরণার দিন। প্রতি বছরের মতো সারা বিশ্বে আজো দিনটি পালিত হচ্ছে। তবে বিশ্বে মহামারি কোভিড-১৯ আতঙ্কের কারণে আজ অনেকটা ঘরোয়াভাবেই পালিত হচ্ছে দিনটি। মানবতার ধর্ম ইসলামে শ্রমিকের স্বার্থ পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে এবং তাদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
মানুষের উন্নতির চাবিকাঠি হলো শ্রম। শ্রমের মর্যাদা সমাজের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে। শ্রমের ব্যাপারে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআন মাজিদে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘অতঃপর যখন নামাজ শেষ হবে, তখন তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণ করো।’ -সূরা জুমা: ১০
ইসলামে কোনো বৈধ শ্রমই অমর্যাদাকর নয়। শ্রম দ্বারা অর্জিত খাদ্যকে ইসলাম সর্বোৎকৃষ্ট খাদ্য হিসেবে আখ্যা দিয়েছে এবং জীবিকা অন্বেষণকে উত্তম ইবাদত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘ফরজ ইবাদতের পর হালাল রুজি অর্জন করাও একটি ফরজ ইবাদত।’ -বায়হাকি
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআন মাজিদে ইরশাদ করেছেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য ভূমি সুগম করে দিয়েছেন। কাজেই তোমরা এর দিক-দিগন্তে বিচরণ করো এবং তার দেওয়া রিজিক থেকে আহার করো।’ -সূরা মুলক: ১৫
আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্রমকে ভালোবাসতেন। তিনি নিজ হাতে জুতা মেরামত করেছেন, কাপড়ে তালি লাগিয়েছেন, মাঠে মেষ চরিয়েছেন। নবীজী ব্যবসা পরিচালনাও করেছেন। খন্দকের যুদ্ধে নিজ হাতে পরিখা খনন করে শ্রমের মর্যাদাকে সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শ্রমিকের মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘শ্রমিক আল্লাহর বন্ধু।’ -বায়হাকি
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে আরও বলেন, ‘নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য আর নেই। আল্লাহর নবী হজরত দাউদ (আ.) নিজের হাতে কাজ করে খেতেন।’ -সহিহ বোখারি
কোরআন-হাদিস, ইসলামের ইতিহাস পড়লে জানা যায়, নবী-রাসূলগণ শ্রমিকদের কত মর্যাদা দিয়েছেন। ইসলামের চিরন্তন শান্তির আলোয় উদ্ভাসিত ক্রীতদাস হজরত বিলাল (রা.) মুক্ত মানুষে পরিণত হন। তাকে সাহাবায়ে কিরাম ‘সাইয়েদুনা’ বা আমাদের নেতা বলে সম্বোধন করতেন। তাকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতিশয় সম্মানজনক মুয়াজ্জিন পদে নিযুক্ত করেন। মক্কা বিজয় করে কাবা ঘরে প্রথম প্রবেশের সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত বেলাল (রা.) ও আরেক ক্রীতদাস হজরত খাব্বাব (রা.)-কে সাথে রেখেছিলেন। নবীজী কখনো নিজ খাদেম হজরত আনাস (রা.)-কে ধমক দেননি এবং কখনও কোনো প্রকার কটূবাক্য ও কৈফিয়ত তলব করেননি। এ সম্পর্কে হজরত আনাস (রা.) নিজেই বলেন, ‘আমি দশ বছর যাবৎ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমত করেছি। তিনি আমার সম্পর্কে কখনো উহ! শব্দটিও বলেননি এবং কখনো বলেননি, এটা করোনি কেন? এটা করেছো কেন? আমার অনেক কাজ তিনি নিজ হাতে করে দিতেন।’ -সহিহ বোখারি
শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তারা (যারা তোমাদের কাজ করে) তোমাদের ভাই। আল্লাহতায়ালা তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। সে (মালিক) যা খায় তার অধীনস্থদেরও যেন তাই খেতে দেয়, সে (মালিক) যা পরিধান করে তাদেরকে যেন তা পরিধান করায়। আর তাকে এমন কর্মভার দেবে না যা তার ক্ষমতার বাইরে। এমন কাজ হলে তাকে (শ্রমিককে) যেন সাহায্য করে।’ -সহিহ বোখারি ও সহিহ মুসলিম
শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে তিল তিল করে গড়ে উঠে শিল্প প্রতিষ্ঠান। অথচ শ্রমিকরা সব সময়ই থেকে যায় নিষ্পেষিত ও উপেক্ষিত। করোনার কারণে শ্রমিকরা আজ ঘরে বন্দী। তাদের ঘরে খাবার নেই। বিশেষ করে পরিবহন শ্রমিকরা এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে ক্ষুধার তাড়নায় দিশেহারা। শ্রমিকের বেতন-ভাতার ব্যাপারে রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার পারিশ্রমিক পরিশোধ করো।’ -সুনানে ইবনে মাজাহ
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির প্রতিপক্ষ হব। যে আমার নামে কোনো চুক্তি করে তা বাতিল করেছে। যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করেছে এবং যে শ্রমিকের দ্বারা পুরোপুরি কাজ আদায় করে নিয়েছে, কিন্তু তার পারিশ্রমিক প্রদান করেনি।’ -সহিহ বোখারি
শ্রমজীবী মানুষ বা কোনো শ্রমিক অবসর নেওয়ার পর তার বাকি জীবন চলার জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা বা পেনশনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এ ব্যাপারেও ইসলাম নীরব নয়। এ সম্পর্কে হজরত ওমর (রা.) বলেছেন, ‘যৌবনকালে যে ব্যক্তি শ্রম দিয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের সেবা করেছেন বৃদ্ধকালে সরকার তার হাতে ভিক্ষার ঝুলি তুলে দিতে পারে না।’
১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেটে অধিকার বঞ্চিত শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজসহ বিভিন্ন দাবিতে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করে। বিক্ষোভ সমাবেশে নিরীহ শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। নিহত হন অনেক শ্রমিক। শ্রমজীবী মানুষের আপসহীন মনোভাব ও আত্মত্যাগের ফলে মালিক পক্ষ শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী ৮ ঘণ্টা কাজের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১ মে শ্রমিক আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়। হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস, শ্রমিকদের সাধ্যের অতীত কাজে কখনও খাটাবে না- এ নির্দেশনামূলক কথাটির কিছু অংশ হলেও ১ মে’র আন্দোলনে প্রতিফলিত হয়।
চলমান বৈশ্বিক মহামারি করোনায় শ্রমিকরা জুলুমের শিকার। একদিকে মুনাফার চাপে শ্রমিককে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে চিকিৎসাব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণ চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে। আগামী দিনে বাংলাদেশসহ বিশ্ব শ্রমিকরা নিজেদের প্রয়োজনে ইসলামের দেওয়া শ্রমের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী: প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক