ওজনে কম দেওয়া পাপ ও আজাবের কারণ

বিশেষ নিবন্ধ, ইসলাম

জাওয়াদ তাহের, অতিথি লেখক, ইসলাম | 2023-09-01 22:02:18

আল্লাহতায়ালা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। দুনিয়াতে বসবাসের জন্য তাদেরকে নানা বিধি-নিষেধ দিয়েছেন। যারা আল্লাহতায়ালার হুকুম মেনে চলে, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। আর যারা অবাধ্য, বিভিন্ন অপরাধে নিজেকে কলুষিত করেছে; তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। দুনিয়ায় এমন কিছু অপরাধ এমন রয়েছে- যা আল্লাহতায়ালার ক্রোধকে ত্বরান্বিত করে। এর একটি হলো- ওজনে কম দেওয়া। পরিমাপ এবং ওজনে কম দেওয়া কবিরা গোনাহ।

এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যারা মাপে কম করে তাদের জন্যে দুর্ভোগ, যারা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয় তখন পূর্ণমাত্রায় নেয়, এবং যখন লোকদের মেপে দেয় কিংবা ওজন করে দেয়, তখন কম করে দেয়; তারা কি চিন্তা করে না তারা পুনরুত্থিত হবে- সেই মহাদিবসে।’ -সূরা মুতাফফিফিন: ১-৫

কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘মেপে দেওয়ার সময় পূর্ণ মাপে দেবে এবং সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওজন করবে। এটা উত্তম, এর পরিণাম শুভ।’ -সূরা বনি ইসরাঈল: ৩৫

কোরআনের অন্যত্র আরও ইরশাদ হচ্ছে, ‘সোজা দাঁড়িপাল্লায় ওজন করো, মানুষকে তাদের বস্তু কম দিয়ো না।’ –সূরা শুয়ারা: ১৮২-১৮৩

আরও ইরশাদ হচ্ছে, ‘ন্যায়ের সঙ্গে ওজন ও মাপ পূর্ণ করো।’ –সূরা আনআম: ১৫২

আল্লাহর নবী হজরত শোয়াইব আলাইহিস সালাম তার জাতিকে বলেছিলেন, ‘তোমরা মাপ ও ওজনে পূর্ণ করো এবং মানুষকে তাদের দ্রব্যাদি কম দিয়ো না।’ –সূরা আরাফ: ৮৫

ওজন পরিমাপে কম না দেওয়ার বিষয়ে এতগুলো আয়াত আল্লাহতায়ালা নাজিল করেছেন, যেখানে কোরআনের একটি আয়াতই আমাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। বিষয়টির গুরুত্ব বুঝানোর জন্য এতগুলো আয়াত নাজিল করা হয়েছে। কারণ যে সমাজ এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে, সে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে এটা আল্লাহতায়ালা ভালো করেই জানেন।

বর্তমানের কেনাবেচা, বাজার ব্যবস্থাপনা ও পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে প্রতারণার বিষয়টি প্রকট আবার ধারণ করেছে। পণ্যে ভেজাল মিশ্রণ, ওজনে কম দেওয়া এসব তো সাধারণ বিষয়। প্রতারণার এক ভয়াবহ অবস্থার মাঝে আমাদের বসবাস। প্রতারণা করা হচ্ছে বিভিন্নভাবে। কখনও সরাসরি পণ্যে, পণ্যের মানে, সংখ্যায়, ওজনে, মেয়াদে। আবার কখনও পণ্যের মৌলিক গুণাগুণ কিংবা তার উৎস গোপন করে তাতে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে।

মাপে কম দেওয়ার অপরাধে আল্লাহতাআলা একটি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছেন। বিষয়টি আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে এভাবে বলেছেন, ‘মাদিয়ানবাসীদের প্রতি তাদের ভাই শোয়াইবকে আমি পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিল, হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। তিনি ছাড়া তোমাদের অন্যকোনো উপাস্য নেই। আর ওজন ও পরিমাপে কম দিয়ো না। আমি তো দেখছি তোমরা সমৃদ্ধিশালী (এর পরও তোমরা ওজনে কম দিলে), আমি তোমাদের জন্য এক সর্বগ্রাসী দিনের আজাবের আশঙ্কা করছি।’ –সূরা হুদ: ৮৪

হজরত শোয়াইব (আ.)-এর জাতির ওপর আজাব এসেছে বিশেষভাবে পরিমাপ ও ওজনে অসততার কারণে। তাই এ ধরণের প্রতারণা থেকে বেঁচে থাকা উচিত। আমাদের অতিরিক্ত লোভ ও অল্পে তুষ্ট না হওয়ার কারণে অবৈধপন্থায় উপার্জনের পেছনে ছুটে বেড়াই। এটা কোরআনের ভাষায় অত্যন্ত ঘৃণিত ও নিন্দনীয় কাজ। সমাজে অনেক লোক রয়েছে, যারা বিভিন্ন উপায়ে, ছলে-বলে ও কৌশলে মানুষ ঠকায় এবং এটাকে নিজের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা মনে করে, উন্নতির অবলম্বন মনে করে। এটা ভুল ধারণা ও মারাত্মক অন্যায়ের কাজ।

ব্যবসায়-বাণিজ্যে মানুষের সঙ্গে প্রতারণার বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি এসেছে। হজরত আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির সঙ্গে আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না; তাদের পবিত্র করবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি (নবী করিম সা.) এটা তিনবার বললেন। হজরত আবু জর (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এরা কারা? তিনি বললেন, এরা হলো তারা- যারা টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে কাপড় পরে, দান করে খোটা দেয় ও মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করে।’ –সহিহ মুসলিম: ১০৬

ব্যবসায় ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের স্বার্থ রক্ষার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। তাই ব্যবসায় ক্রেতা-বিক্রেতার স্বার্থের প্রতি খেয়ালা রাখতে হবে। এর একটি চমৎকার বিবরণ তাবারানি শরিফে এসেছে (হাদিস: ২৩৯৫)। হাফেজ আবুল কাসিম তাবরানি বর্ণনা করেন, জারির বিন আব্দুলাহ আল বাজালি (রা.) তার স্বাধীন করে দেওয়া দাসকে তার জন্য একটি ঘোড়া কিনে আনার আদেশ দিলেন। সে তিনশ’ দেরহামে একটি ঘোড়া কিনে আনে। ঘোড়াটি আনার সময় সঙ্গে মালিককেও নিয়ে আসে। যাতে জারির তার হাতে নগদ মূল্য পরিশোধ করতে পারেন। জারির ঘোড়ার মালিককে বলল, তিনশ’ দেরহামের তুলনায় তোমার ঘোড়াটি অধিক উত্তম। সুতরাং তুমি কি চারশ’ দেরহামে তা বিক্রি করবে? সে বলল, হে আবু আব্দুলাহ! এটি আপনার ব্যাপার। অত:পর তিনি বললেন, তোমার ঘোড়াটি তো এর চেয়েও উত্তম, তুমি কি তা পাঁচশ’ দেরহামে বিক্রি করবে? এভাবে তিনি ঘোড়ার মূল্য বাড়াতে লাগলেন, ঘোড়ার মালিকটিও এতে খুশি হচ্ছিল। এক সময়ে ঘোড়াটির মূল্য দাঁড়ালো আটশ’ দেরহামে। তিনি সে দামেই তা ক্রয় করে নিলেন। পরে এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি উত্তরে বলেন, প্রতিটি মুলসলমানের জন্য কল্যাণ চাওয়ার ব্যাপারে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে বায়াত (শপথ) গ্রহণ করেছি।’

যারা সৎ পথে ব্যবসা করেন, তারা দুনিয়া-আখেরাতে প্রভূত কল্যাণ ও বরকত লাভ করেন। সৎ ব্যবসায়ী পরকালে নবী ও সিদ্দিকগণের সঙ্গে থাকবেন। হজরত আবু সাঈদ (রা.) নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘সত্যবাদী আমানতদার ব্যবসায়ী নবীগণ, সিদ্দিকগণ ও শহীদগণের সঙ্গে থাকবেন।’ –সুনানে তিরমিজি: ১২০৯

জাওয়াদ তাহের: সিনিয়র শিক্ষক, জামিয়া বাবুুস সালাম, বিমানবন্দর, উত্তরা, ঢাকা

এ সম্পর্কিত আরও খবর