করোনাভাইরাসের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে বিশ্ব। সৃষ্টি হচ্ছে নানা ধরনের নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতা। কর্মহীন হয়ে গেছে বৃহৎ জনগোষ্ঠী, অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের নিয়মিত বেতন দিতে পারছে না। অসহায় হয়ে পড়েছে নিন্ম আয়ের লোকজন। ফলে সংসার পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছেন কর্মহীন কিংবা বেমন না পাওয়া পরিবারের অভিভাবকরা। এমতাবস্থায় সরকারের পাশাপাশি প্রত্যেকের নিজস্ব অবস্থান থেকে অসহায়, অভাবী মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। শুধু ত্রাণ নয়, নানাভাবে তাদের পাশে দাঁড়ানো যেতে পারে। এর একটি হলো- ‘করজে হাসানা’।
আর্থিক ইবাদতের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ ইবাদত হলো- ‘করজে হাসানা’ তথা উত্তম ঋণ। পবিত্র কোরআনের ৬টি আয়াতে মোট ১২টি স্থানে করজে হাসানার কথা উল্লেখিত হয়েছে। প্রত্যেক স্থানেই করজকে হাসানার সঙ্গে র্বণনা করা হয়েছে। এর দ্বারা বুঝা যায়, করজে হাসানা একটি ইবাদত এবং কল্যাণময় আমল। এটা মানবতার জন্য বিশেষ দয়াও বটে।
কোরআনে কারিমে ব্যবহৃত করজে হাসানা (উত্তম ঋণ) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- আল্লাহতায়ালার রাস্তায় খরচ করা, অভাবী, এতিম ও বিধবাদের ব্যয়ভার বহন করা, ঋণী ব্যক্তিদের ঋণ পরিশোধে সাহায্য করা এবং নিজ সন্তানাদি ও পরিবারের ওপর খরচ করা।
মোটকথা, মানবকল্যাণের যত দিক আছে সবগুলোই এর অন্তর্ভুক্ত। এমনিভাবে কোনো অভাবী ও চিন্তাগ্রস্থকে এই নিয়তে ঋণ দেওয়া যে, ওই ব্যক্তি যদি স্বীয় সামর্থ্য ও চিন্তার দরূণ ঋণ পরিশোধ করতে না পারে, তবে তার কাছে আর চাওয়া হবে না। এটাও করজে হাসানার অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এমন কে আছে, যে আল্লাহকে করজ দেবে উত্তম করজ? অতঃপর আল্লাহতায়ালা তাকে দ্বিগুণ ও বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেবেন। আল্লাহতায়ালাই সঙ্কোচিত করেন আবার তিনিই প্রশস্ততা দান করেন এবং তারই নিকট তোমরা ফিরে যাবে।’ –সূরা আল বাকারা: ২৪৫
কোরআনে কারিমের অন্যত্র আরও ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা আল্লাহকে উত্তম পন্থায় ঋণ দিতে থাকো, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের গোনাহ দূর করে দেবো এবং অবশ্যই তোমাদেরকে উদ্যানসমূহে প্রবিষ্ট করবো, যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত।’ –সূরা আল মায়িদা: ১২
আরও ইরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারীরা যারা আল্লাহকে উত্তমরূপে ধার দেয়, তাদেরকে দেওয়া হবে বহুগুণ এবং তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার।’ –সূরা আল হাদিদ: ১৮
আল্লাহতায়ালা অমুখাপেক্ষী হওয়া সত্ত্বেও কেন ঋণ চাইলেন? উত্তর, মানুষকে করজে হাসানা প্রদানের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য। স্বতস্ফূর্তভাবে সমস্যার শিকার ব্যক্তিকে ঋণ প্রদান করা স্বয়ং আল্লাহতায়ালাকে ঋণ দেওয়ার মতো।
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষ্য অনুযায়ী, দানের চেয়ে ঋণ প্রদানের গুরুত্ব বেশি। দানের সওয়াব দশ গুণ আর ঋণ প্রদানের সওয়ার আঠারো গুণ।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, যখন করজে হাসানা সম্পর্কে কোরআনে কারিমের আয়াত নাজিল হলো- তখন হজরত আবু দারদা আনসারি (রা.) হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে হাজির হয়ে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহতায়ালা কি আমাদের কাছে ঋণ চান? উত্তরে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন- হ্যাঁ। তখন আনসারি সাহাবি বললেন, হুজুর! আপনার হস্ত মোবারক সামনে বাড়িয়ে দিন, আপনার হাতে হাত রেখে আমি একটি অঙ্গীকার করবো। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হাত বাড়িয়ে দিলেন। তখন হজরত আবু দারদা (রা.) হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাত ধরে অঙ্গীকার করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আমার বাগান আল্লাহতায়ালাকে করজ হিসেবে দিয়ে দিলাম। ওই বাগানে ৬০০ খেজুর গাছ ছিলো এবং ওই বাগানে তার স্ত্রী-সন্তানও থাকতো। তিনি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবার হতে উঠে নিজ বাগানে চলে গেলেন এবং স্বীয় স্ত্রীকে আওয়াজ দিয়ে বললেন, চলো এই বাগান থেকে বের হয়ে এসো। এই বাগান আমি আমার রবকে করজ দিয়ে দিয়েছি। -তাফসিরে ইবনে কাসির
হজরত আবু দারদা (রা.)-এর দু’টি বাগান ছিলো। তন্মধ্যে এই বাগানটিই ছিলো তার নিকট খুব প্রিয়। যে বাগানে ৬০০ খেজুর গাছ ছিলো এবং ওই বাগানে তার স্ত্রী-সন্তানও থাকতো। এটিই তিনি স্বীয় রবকে করজ হিসেবে দিয়ে দিলেন। এই সব ব্যক্তিদের প্রশংসায় আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তারা নিজেদের ওপর অন্যদেরকে প্রাধান্য দেয়।’ –সূরা হাশর: ৯
বিত্তশালীরা করজে হাসানা নামক আর্থিক ইবাদতটি সম্পাদন করলে সমাজের অবহেলিত ও দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষগুলো নিজ পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়।
জাতীয় উৎপাদনে তারা তাদের কর্মশক্তি নিয়োগ করতে পারে। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলো শক্তি অর্জন করে অভাবের তাড়না থেকে মুক্তি পেতে পারে। সেই সঙ্গে যারা অসহায়ত্বের শিকার হয়ে সুদে ঋণগ্রহণ করে তাদেরকে সুদ নামক ভয়ানক অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে।
আমাদের দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে কর্জে হাসানা চালু থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করজে হাসানা প্রদানের সংস্কৃতি এখনও চালু হয়নি। বিভিন্ন ইসলামি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ট্রাস্ট বিনা সুদে ছোট ও মাঝারি আকারের ঋণ প্রদান করে অসহায় পরিবারগুলোকে আত্মনির্ভরশীল করার পথ দেখাতে পারে।
করজে হাসানা হতে পারে দারিদ্র্য বিমোচনের ব্যাপকভিত্তিক শক্তিশালী মডেল এবং সুদি ঋণের উত্তম বিকল্প। তাছাড়া করজে হাসান বা সুদমুক্ত ঋণ প্রদানের মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র লোকদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। যারা অত্যন্ত অসহায়ত্বের শিকার তাদেরকে করজে হাসানা প্রদান করে ছোটখাটো কোনো ব্যবসা ধরিয়ে দিয়ে দারিদ্র বিমোচনের ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনা যায়। যেমন পোশাক তৈরি, এমব্রয়ডারি, কিচেন ব্যবস্থাপনা, খাদ্য তৈরি, মোটরসাইকেল মেকানিক, অটোমেকানিক, হাঁস-মুরগির খামার, কম্পিউটার সফটওয়্যার, ওয়েল্ডিং, কাঠের সরঞ্জাম তৈরি, ছাগল পালন ইত্যাদি।
তাছাড়া অসচ্ছল পরিবারের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাঋণ দিয়ে নিরক্ষতা দূরীভূত করা যায়। করজে হাসানায় কোনো ধরনের সুদ, সার্ভিস চার্জ, লোন প্রসেসিং ফি, মুনাফা ও জরিমানা থাকে না। নির্ধারিত মেয়াদের ভেতরে মূল টাকা ফেরত দিতে হয়।
মোটকথা, সুদিঋণ প্রথা বিমোচন করার জন্য করজে হাসানার ব্যাপক চর্চার মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এতে একদিকে যেমন দরিদ্র মানুষ লাভবান হবে অন্যদিকে সুদের বিষাক্ত ছোবল থেকে সমাজের মানুষকে রক্ষা করা যাবে। আর করজে হাসানা দাতার জন্য তো অগণিত সওয়াবের ওয়াদা আছেই।