আল্লাহতায়ালা মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তার ইবাদতের জন্য। ইবাদতের মাধ্যমে বান্দা শুধুমাত্র বাহ্যিকভাবে কয়েকটি আনুষ্ঠানিকতা পালন করে না, বরং ইবাদত একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর নিমিত্তে হওয়ার জন্যে চাই একনিষ্ঠতা ও একাগ্রচিত্ততা। যা বান্দা ক্রমাগতভাবে করতে থাকলে অর্জন করে মহামূল্যবান নিয়ামত, যাকে ইসলামি শরিয়তে ‘তাকওয়া’ নামে আখ্যায়িত করা হয়।
তাকওয়া আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, পরহেজ করা, বেঁচে থাকা ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায় তাকওয়া হলো- একমাত্র আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। যে ব্যক্তির মধ্যে তাকওয়া থাকে, তাকে মুক্তাকি বলা হয়। সৎ গুণাবলির মধ্যে তাকওয়া হচ্ছে অন্যতম। যার মধ্যে তাকওয়া থাকে, সে পার্থিব জীবনের লোভে কোনো খারাপ কাজ করে না। সে পরকালীন জীবনের কল্যাণের কাজে সবসময় নিজেকে নিয়োজিত রাখে।
তাকওয়া হলো- জীবনের প্রতিটি কাজকর্মের অগ্র-পশ্চাতে, দিবা-নিশিতে আল্লাহর ভয়কে অন্তরে জাগরুক রাখা। আল্লাহর ভয়কে অন্তরে জাগরুক রেখে আমলের প্রতিটি স্তর পার হতে পারলেই সে তাকওয়া অবলম্বনকারী মুমিন মুত্তাকি হবে।
ভিন্নভাবেও বলা চলে, সকল প্রকার অনিষ্ট কাজ থেকে আল্লাহর ভয়ে নিজেকে বাঁচানোর অন্য নামই হলো- তাকওয়া। তাকওয়ার মধ্য দিয়ে একজন মুমিন পরিশুদ্ধতা লাভ করে, ঈমানশুদ্ধতার আত্মিক সুখ-শান্তি লাভ করে। তৌহিদের উপস্থিত প্রফুল্লতায় ভরে উঠে জীবনের চারিধার। তাই একজন মানুষকে মানুষ হতে হলে সর্বাগ্রে তাকে তাকওয়া অবলম্বন করতে হবে। তাকওয়াহীন মানুষ হওয়া অসম্ভব। তাকওয়া তথা আল্লাহর ভয়ে সমাজের কল্যাণকামিতা যদি সদা অন্তরে জাগ্রত না থাকে, তাহলে তার দ্বারা ভালো কাজের আশা করা যায় না। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে দুর্নীতি করা যায়, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যায়, দায়িত্বে অবহেলা করা যায়, আমানতের খিয়ানত করা যায়- কিন্তু আল্লাহর চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। এ কারণে তাকওয়াহীন মানুষ মানুষই হতে পারে না।
সকল প্রকার গোনাহ থেকে সর্বদা নিজেকে গুটিয়ে শরীর ও মনকে পাপ থেকে অক্ষত রেখে দুনিয়ার জীবন পাড়ি দেওয়ার নামই হলো- তাকওয়া। এ জন্য তাকওয়া অবলম্বন করতে বর্তমান সমাজে সুদ, ঘুষ ও দুর্নীতির কাঁটা থেকে একজন মুমিনকে আত্মরক্ষা করে খুব সতর্কতার সঙ্গে জীবনপথ পাড়ি দিতে হবে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে শিরক, কবিরা গোনাহ, অশ্লীল কাজকর্ম ও কথাবার্তা থেকে বিরত রাখে, তাকে মুত্তাকি বলা হয়।’ মুত্তাকি ব্যক্তি সততা, আমানতদারিতা, ধৈর্য, শোকর, আদল-ইনসাফ ইত্যাদি সব ধরনের গুণে গুণান্বিত হয়ে থাকেন।
তাকওয়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট অনেক বর্ণনা করে বয়ান করা হয়েছে। যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তাদেরকে শরিয়তের পরিভাষায় বলা হয় মুত্তাকি। মুত্তাকিদের পরিচয় প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা অদৃশ্যের প্রতি ঈমান রাখে, নামাজ আদায় করে এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। আর যারা আপনার ওপর যা নাজিল করা হয়েছে (কোরআন) এবং আপনার আগে যা নাজিল করা হয়েছে (আসমানি কিতাব) তার প্রতি ঈমান রাখে, আর তারা আখেরাতের প্রতি ইয়াকিন রাখে।’ -সূরা আল বাকারা: ৩-৪
তাকওয়া দৃশ্যমান কোনো বস্তু নয়। এটা মূলত মানুষের আভ্যন্তরীণ গুণবিশেষ। তাকওয়ার স্থান সম্পর্কে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তাকওয়া বা আল্লাহভীতি এখানে থাকে, এ কথা বলে তিনি তিনবার নিজের বুকের দিকে ইশারা করলেন। তাকওয়া যেহেতু অন্তরে থাকে, তাই আল্লাহর রাসূল (সা.) অন্তর পরিষ্কার করার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, মনে রেখো, নিশ্চয়ই মানুষের শরীরে একটি গোশতের টুকরো আছে, যা ঠিক থাকলে সমস্ত দেহই ঠিক থাকে। আর তার বিকৃতি ঘটলে সমস্ত দেহেরই বিকৃতি ঘটে। সে গোশতের টুকরাটি হলো- ‘অন্তর।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম
তাকওয়া অবলম্বনের উপকারিতা
তাকওয়া অবলম্বনকারীকে আল্লাহতয়ালা পরিমিত রিজিক দান করেন, ‘যে কেউ আল্লাহতায়ালার ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বন করবে, আল্লাহ তার জন্য সঙ্কট থেকে উত্তোরণের কোনো পথ তৈরি করে দেবেন এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিজিক দেবেন যা তার ধারণারও বাইরে।’ –সূরা তালাক: ২
কেউ তাকওয়া সম্বলিত সুন্দর চরিত্র নির্মাণ করতে পারলে তার রিজিকের অভাব হবে না। এই আয়াত থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়। তাকওয়া অবলম্বনকারীর জন্য রয়েছে আল্লাহর অফুরন্ত ভালোবাসা ও ভালোলাগা। একজন মানুষের জন্য এর থেকে সুন্দর আর উত্তম কোনো প্রতিদান কি হতে পারে যে, আল্লাহতায়ালা তাকে ভালোবাসেন, কখনোই তার থেকে উত্তম কোনো প্রতিদান হতে পারে না। আর এই প্রতিদানটা পাওয়া যাবে চরিত্রের মধ্যে তাকওয়া সম্ভলিত চরিত্র নির্মাণ করলে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাকওয়া অবলম্বনকারী মুত্তাকিনদের ভালোবাসেন।’ –সূরা আলে ইমরান: ৭৬
তাকওয়া অবলম্বনকারীর ভাগ্যে আল্লাহর নাজাত মিলে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘(আগেও) যারা ঈমান গ্রহণ করেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে তাদেরকে আমি রক্ষা করেছি (নাজাত দিয়েছি)।’ –সূরা হামিম: ১৮
তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দার আমল কবুল হয়। ‘আল্লাহ শুধুমাত্র মুত্তাকিদের ইবাদত কবুল করেন।’ –সূরা মায়িদা: ২৭
তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দার কোনো ভয় থাকবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে এবং নিজেকে সংশোধন করেছে কিয়ামতের দিন তার কোনো ভয় নেই এবং কোনো দুশ্চিন্তায়ও তাকে গ্রাস করবে না।’ –সূরা আরাফ: ৩৫
তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দার পুরস্কার বড় করে দেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ ওই ব্যক্তির গোনাহ (তার আমলনামা থেকে) মুছে ফেলেন এবং তার পুরস্কারকে বড় করে দেন।’ –সূরা তালাক: ৫
তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দার কাজ আল্লাহ সহজ করে দেবেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে তাকওয়া অবলম্বন করলো, আল্লাহ তার জন্যে কাজগুলোকে সহজ করে দেবেন। -সূরা তালাক: ৪
তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দার জন্যে জমিন ও আসমানের বরকতের দরজা খুলে দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি এলাকার লোকজন ঈমান আনয়ন করতো এবং সঙ্গে সঙ্গে তাকওয়া অবলম্বন করতো, তাহলে আমি আল্লাহ তাদের আসমান ও জমিনে বরকতের দরজাসমূহ খোলে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে (আমার আয়াতকে) তাদেরকে আমি পাকড়াও করবো তাদের অর্জিত পাপের কারণে।’ –সূরা আরাফ: ৯৬
তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দার ভেতরে হক-বাতিল বুঝার ও পার্থক্য করার বিবেক সৃষ্টি হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো, তোমাদের জন্যে আল্লাহ সত্য-মিথ্যা, হক-বাতিল অনুধাবন করার বুঝ দেবেন, তোমাদের থেকে মন্দগুলো দূর করবেন এবং গোনাহসমূহকে ক্ষমা করে দেবেন। মহান আল্লাহ বড় দয়ালু ও রহমওয়ালা।’ –সূরা আনআম: ২৯
তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দারা দুনিয়া ও আখেরাতে সুসংবাদ লাভ করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান এনেছে ও তাকওয়া অবলম্বন করেছে, তাদের জন্যে পার্থিব ও আখেরাতের সুসংবাদ রয়েছে। আল্লাহর কথা কখনও পরিবর্তন হবে নাম এগুলো মহাসাফল্য।’ –সূরা ইউনুস: ৬৩-৬৭
বস্তুত গোনাহের পরিস্থিতি তৈরি হলে আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করা এবং গোনাহ ত্যাগ করা তাকওয়ার একটি প্রকার। এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তি আল্লাহর কাছে মুত্তাকি হিসেবে গণ্য।
তাকওয়ার ক্ষেত্র সীমাহীন বিস্তৃত। এটি যেকোনো ধরনের পদস্খলন থেকে মানুষকে রক্ষা করে, সব মন্দ ও অশ্লীল কথা, কাজ ও পরিবেশ থেকে ফিরিয়ে রাখে। প্রবৃত্তির খেয়ালখুশি ও দুষ্টচক্রের ফাঁদে পড়ে নিজের ক্ষতি করা থেকে এবং পরিবার, সমাজ ও দেশের ক্ষতি করা থেকে রক্ষা করে। তাকওয়া জীবনকে এমন এক সুদৃঢ ভিত্তির ওপর স্থাপন করে, যা সব ধরনের ভীতি, লোভ-লালসা, প্ররোচণা, প্রতারণা, প্রলোভন, পদস্খলন থেকে মানুষকে নিরাপদ রাখে।
মুফতি আহমদ যাকারিয়া: শুরা সদস্য, সিয়ানাহ ট্রাস্ট সিলেট