মধ্য চীনের উহান শহর থেকে কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস রোগের সূচনা। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এর পর ১১ জানুয়ারি প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। ঠিক কীভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয় তা এখনও নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করতে পারেনি বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ৷ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে৷ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে প্রথম সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হবার তিন মাস পুরো হয়েছে ৮ জুন।
১৩ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কিন্তু এই সময়টা আলেম-উলামাদের কাছে বেদনাদায়ক সময় হিসেবে চিহ্নিত। কারণ করোনার দহনকালে বাংলাদেশে আমরা হারিয়েছি শ্রদ্ধাভাজন ও শীর্ষস্থানীয় আলেমদের। অল্প সময়ের ব্যবধানে এতজন প্রতিথযশা আলেমের ইন্তেকাল বাংলাদেশের ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য দুঃখজনক বিষয়।
এই আলেমরা কোরআন-হাদিসের শিক্ষা বিস্তার এবং দ্বীনের খেদমতে সারা জীবন ত্যাগ করেছেন। শিরক, বিদআত, কুসংস্কারমুক্ত জীবন গঠনে মানুষকে পথ দেখিয়েছেন। সুন্নতে রাসূলের পরিপূর্ণ অনুসরণসহ মানবতার কল্যাণে জীবন ব্যয় করেছেন। ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং ইসলাম অবমাননারোধসহ ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠী মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আমাদের মাঝে তাদের অবস্থান ছিলো রহমতস্বরূপ, তারা ছিলেন আমাদের অভিভাবক।
আমরা জানি, নির্ধারিত সময় এলে সবাইকে চলে যেতে হবে। আল্লাহতায়ালার এ বিধানকে বিশ্বাস করতে হবে। হাদিসের ভাষ্য, ‘মওতুল আলেমে, মওতুল আলামে’ একজন আলেমের মৃত্যু যেন একটি জাহানের মৃত্যু। আলেমরা হচ্ছেন- পৃথিবীর বুকে হেদায়েতের বাতিস্বরূপ।
পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের মাঝে তারা থাকা অবস্থায় তাদের মূল্যায়ন করি না। বরং তাদের দুর্বলতাগুলোর দিকে তাকিয়ে, তাদের গুণাবলি সম্পর্কে উদাসীন ছিলাম। তাদের দ্বারা যতটুকু উপকৃত হওয়া সম্ভব সেটা গ্রহণ করি না। কিন্তু যখন তারা বিদায় নিয়ে চলে যান, তখন তাদের মূল্য অনুধাবন করে আফসোস করি। উপলব্ধিটা আগে আসে না। এই মন্দ স্বভাব আমাদের থেকে কবে বিদায় নেবে জানি না। তবে এর অবসান দরকার। আমাদের অপরিহার্য কর্তব্য হলো- আমরা যেন বর্তমান আকাবিরের মূল্য দেই এবং সর্বদা তাদের সুস্থতা ও দীর্ঘ হায়াতের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করি। আল্লাহতায়ালা যেন আমাদেরকে তাদের মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার তওফিক দান করেন এবং নির্ধারিত সময়ে তাদের বিদায়ের পর তাদের যোগ্য উত্তরসূরী তৈরি করে দেন।
বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী (৮ মার্চ) শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ১২ জুন পর্যন্ত ইন্তেকাল হওয়া আলেম ও ইসলামি রাজনীতিকদের কয়েকজনকে নিয়ে আজকের এই লেখা। লেখায় ক্রমিক সাজানো হয়েছে মৃত্যুর তারিখ হিসেবে।
আল্লামা আবদুল আলীম আল-হুসাইনী রহ.
১৮ মার্চ রাতে ইন্তেকাল করেন নারায়ণগঞ্জ ঐতিহ্যবাহী হাজীপাড়া মাদরাসার শাইখুল হাদিস আল্লামা আবদুল আলীম আল-হুসাইনী। তিনি ভারত উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেম শাইখুল আরব ওয়াল আজম সাইয়্যিদ হোসাইন আহমাদ মাদানি রহমাতুল্লাহি আলাইহির দীর্ঘ আট বছর সান্নিধ্য পাওয়া একজন সুযোগ্য শাগরিদ ও হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমাদ শফীর সহপাঠী ছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো প্রায় ১০৪ বছর।
দীর্ঘ ত্রিশ বছর দেশের বিভিন্ন মাদরাসায় বোখারি শরিফের দরস দিয়েছেন। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ মারকাযুল উলূম আল ইসলামিয়া হাজীপাড়া মাদরাসায় তের বছর যাবত শাইখুল হাদিস দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৮ মার্চ রাত আনুমানিক ১১টার দিকে তিনি নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। বার্ধক্যজনিত কারণে দীর্ঘদিন তিনি অসুস্থতায় ভুগতেছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি চার ছেলে, চার মেয়ে এবং অসংখ্য ছাত্র, ভক্ত ও অনুরাগী রেখে গেছেন।
শাইখুল হাদিস আল্লামা আবদুল হাই রহ.
সিলেটের বরেণ্য আলেম ও বাংলাদেশের প্রবীণ আলেমদের অন্যতম শাইখুল হাদিস আল্লামা আবদুল হাই ২৮ মার্চ ইন্তেকাল করেন। নিজ বাড়ির পাশে মারকাজু তালিমিন্নিসা বংশিবপাশা, আজমিরীগঞ্জ, হবিগঞ্জ নামে একটি মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। একইসঙ্গে তিনি সিলেটের একাধিক মাদরাসার শাইখুল হাদিস ছিলেন। বর্ষিয়ান এই আলেম নিজ বাড়িতে বার্ধক্যজনিত কারণে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৯৮ বছর। তিনি পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে সন্তানসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন গুণগ্রাহী ও ছাত্র রেখে যান।
শায়খে ইমামবাড়ি আল্লামা আবদুল মোমিন রহ.
৮ এপ্রিল দিবাগত রাতে ইন্তেকাল করেন উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শাইখুল ইসলাম সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানি রহ.-এর খলিফা, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি ও জামেয়া দারুল কোরআন সিলেটের শাইখুল হাদিস, প্রখ্যাত বুজুর্গ পীরে কামেল আল্লামা শাহ আবদুল মোমিন (শায়খে ইমামবাড়ি)। ৮ এপ্রিল দিবাগত রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে বার্ধক্যজনিত কারণে নিজ গৃহে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৯৯ বছর। মৃত্যুর আগে দীর্ঘদিন তিনি বিভিন্ন শারিরীক অসুস্থতায় ভুগেছেন।
মুফতি ড. আবদুল্লাহ বিক্রমপুরী রহ.
৮ এপ্রিল বাদ মাগরিব ইন্তিকাল করেন ইসলামি অর্থনীতিবিদ, শাইখুল হাদিস, মুফতি ড. আবদুল্লাহ বিক্রমপুরী। কর্মজীবনে তিনি ঢাকার ইসলামপুরস্থ তাতিবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব ছিলেন। এ ছাড়া তিনি ঐতিহ্যবাহী মোস্তফাগঞ্জ মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও শাইখুল হাদিস ছিলেন। তিনি জামালুল কোরআন মাদরাসা গেন্ডারিয়ায় বোখারির দরস দিতেন। তিনি ছিলেন হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা আহমদ শফীর শীর্ষস্থানীয় খলিফাদের মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়া তিনি সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ট্রাস্ট ব্যাংক শরিয়াহ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন। ৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে কুর্মিটোলা মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৬০ বছর।
মাওলানা মুজিবুর রহমান পেশওয়ারী রহ.
১৪ এপ্রিল, মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় ইন্তেকাল করেন খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির, প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ মাওলানা সৈয়দ মুজিবুর রহমান পেশওয়ারী (মির্জাপুরের পীর সাহেব)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৭০। বার্ধক্যজনিত কারণে ও দীর্ঘদিন শারিরীক অসুস্থতায় ভুগে তিনি ইন্তেকাল করেন।
মাওলানা আবদুর রহীম বোখারি রহ.
১৬ এপ্রিল দুপুর ২টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুর রহীম বোখারি। তিনি জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার মুহতামিম আল্লামা মুফতি আবদুল হালিম বোখারীর ছোট ভাই। আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের পরিদর্শক ও চকরিয়া ইমাম বোখারি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। দার্শনিক রাজনীতিবিদ খতিবে আজম আল্লামা ছিদ্দিক আহমদ রহ.-এর একান্ত শিষ্য, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির নেতা, গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী আলেম ও সুবক্তা ছিলেন তিনি।
মাওলানা আবদুর রহীম বোখারি ডায়াবেটিক ও কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ডাক্তারের নিবিড় পরিচর্যায় ছিলেন। তার বয়স হয়েছিলো ৭১। তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে, চার মেয়ে সন্তানসহ অসংখ্য শাগরিদ ও গুণগ্রাহী রেখে যান।
আল্লামা জুবায়ের আহমদ আনসারী রহ.
১৭ এপ্রিল ইন্তেকাল করেন বিশ্বনন্দিত মুফাসসিরে কোরআন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমির, ব্রাহ্মণবাড়িয়া বেড়তলা জামিয়া রাহমানিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল আল্লামা জুবায়ের আহমদ আনসারী। ১৭ এপ্রিল মাগরিবের পূর্বে নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন তিনি।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৭০ বছর। মাওলানা জোবায়ের আহমদ আনসারী দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ ছিলেন। বেশ কয়েক ধরে তিনি দেশ-বিদেশে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি দীর্ঘ সময় আমেরিকায় ছিলেন। তার বেশ কয়েকবার অপারেশন এবং কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছিলো। সর্বশেষ গত কয়েক মাস ধরে তিনি নিজ বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। মাওলানা জোবায়ের আহমদ আনসারী বাংলদেশের একজন প্রখ্যাত ওয়ায়েজ। তিনি প্রায় তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি দাওয়াতি ময়দানে কাজ করেছেন। দাওয়াতি কাজে সফর করেছেন- ইউরোপ আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ।
শায়খুল হাদিস মাওলানা আবদুল মুমিত ঢেউপাশী রহ.
বৃহত্তর সিলেট বিভাগের শীর্ষ আলেম মাওলানা আবদুল মুমিত (৭২) ঢেউপাশী ২৮ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে সিলেট মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মাওলানা আবদুল মুমিত দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। তিনি সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের ঢেউপাশা গ্রামের নিজ বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য সিলেট নগরীর মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। প্রচারবিমুখ সাদাসিধে জীবনের অধিকারী এই আলেম হাদিসের দক্ষ শিক্ষক হিসেবে কওমি অঙ্গনের মাদরাসাগুলোতে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। বুধবার (২৯ এপ্রিল) দেশব্যাপী প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন বিবেচনায় পারিবারিকভাবে জানাজা শেষে নিজ গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
মাওলানা আবদুল মুমিত ঢেউপাশী ১৯৪৮ সালে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের ঢেউপাশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে বৃহত্তর সিলেটের শীর্ষ কওমি মাদরাসা গহরপুর থেকে দাওরায়ে হাদিস পাশ করেন। পারিবারিক জীবনে ৬ ভাই আর ২ বোনের মধ্যে মাওলানা আবদুল মুমিত ঢেউপাশী ছিলেন সবার বড়। তিনি ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক।
মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী রহ.
দেশের প্রবীণ রাজনীতিবীদ, ইসলামী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান ও নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী ১১ মে রাত ৮টা ২৫ মিনিটের দিকে রাজধানীর কাকরাইলে অবস্থিত ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪। ইফতারের পর মাগরিবের নামাজের অজু করতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন মাওলানা নেজামী। এরপর হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নরসিংদীর শিবপুরের মুন্সেফের চর ইটাখোলা ঈদগাহ ময়দানে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়। তিনি দৈনিক সরকার পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি দুই ছেলে ও দুই মেয়েসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজনসহ অগণিত গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। সাদামাটা জীবনের অধিকারী ও সহজ-সরল মানুষ হিসেবে মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামীর খ্যাতি ছিল। তাকে ইসলামি রাজনীতির জীবন্ত কোষ বলা হয়। নেজামে ইসলামে যোগদানের মধ্য দিয়ে তার রাজনীতি শুরু। ইসলামি আন্দোলনের বিভিন্ন বাঁক ও প্রতিকূল মুহূর্তেও তিনি আক্রমণাত্মক বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর হাসিমুখে দিতেন, এটা তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল।
মুফতি ওবায়দুল মাতিন রহ.
ঠাকুরগাঁও গোয়ালপাড়া জামেয়া ইসলামিয়া ইবরাহিমীয়া দারুস সালাম কওমি মাদরাসার মুহতামিম ও শাইখুল হাদিস মাওলানা মুফতি ওবায়দুল মাতিন ৫২ বছর বয়সে ১২ মে ইন্তেকাল করলেন। এর আগে তিনি বাংলাহিলি আজিজিয়া মাদরাসায় প্রধান মুফতির দায়িত্ব পালন করেছেন। দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে তিনি দাওরায়ে হাদিস এবং ইফতা সম্পন্ন করেন। খুলনার খালিশপুরের একটি মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে ২ বসর দায়িত্ব পালন শেষে বাংলাহিলি আজিজিয়া আনোয়ারুল উলুম মাদরাসা, হাকিমপুর, দিনাজপুরে যোগ দেন। সেখানে তিনি মুহাদ্দিস ও মুফতি হিসেবে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। এর পর যোগ দেন ঠাকুরগাঁও, গোয়ালপাড়া দারুসসালাম মাদরাসায়। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেখানে কর্মরত ছিলেন।
মাওলানা মোহাম্মদ আবু তাহের রহ
চট্টগ্রাম দারুল মাআরিফের মুহাদ্দিস মাওলানা মোহাম্মদ আবু তাহের ২০ মে ইন্তেকাল করেন। প্রচারবিমুখ এই আলেম অত্যন্ত পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। ১৯৬০ সালের ১ জানুয়ারি মহেশখালীর অন্তর্গত কালাগাজির পাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পাঁচ ভাইবোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।
১৯৮০ সালে পটিয়া মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। চার ছেলে ও দুই কন্যার জনক মাওলানা মোহাম্মদ আবু তাহের কক্সবাজার খুরুশকুল মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে ৮ বছর শিক্ষকতা শেষে ১৯৮৮ সালে আল্লামা সুলতান যওক নদভীর আহবানে সাড়া দিয়ে দারুল মাআরিফে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এখানে ৩২ বছর শিক্ষকতা করেন। লেখক ও কবি হিসেবে তার বেশ সুনাম রয়েছে। তাকে জামেয়া দারুল মাআরিফের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
আল্লামা শাহ তৈয়ব রহ.
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী কওমি মাদরাসা আল জামিয়াতুল আরাবিয়াতুল ইসলামিয়া জিরি মাদরাসার মুহতামিম আল্লামা শাহ্ তৈয়ব ২৪ মে দিবাগত রাত দেড়টায় চটগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ৭৯ বছর বয়সী প্রবীণ এই আলেম বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহ-সভাপতি ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন।
দেশের অন্যতম শীর্ষ এই আলেম রমজান মাসের শেষ দশকে ইতেকাফ করেছেন। ইতেকাফ শেষে অসুস্থতাবোধ করলে তাকে রাতে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি জায়নামাজে সেজদারত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। জিরি মাদরাসায় তিনি আল্লামা মুফতি নুরুল হক রহ.-এর ইন্তেকালের পর থেকে দীর্ঘ ৩৬ বছর মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেছেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে, পাঁচ মেয়ে, নাতি-নাতনি, অসংখ্য ছাত্র, মুরিদ ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর ইমামতিতে জিরি মাদরাসার মাঠে তার জানাজার নামাজ শেষে মাদরাসা সংলগ্ন কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
আল্লামা শাহ্ মুহাম্মদ ইদ্রিস রহ.
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার জামিয়া আরাবিয়া নাছিরুল উলুম নাজিরহাট বড় মাদরাসার মোহতামিম ও শাইখুল হাদিস আল্লামা শাহ মুহাম্মদ ইদ্রিস ২৭ মে, বুধবার দিবাগত রাত ১২টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ৭৯ বছল বয়সী এই আলেম বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। বৃহস্পতিবার ফজরের নামাজের পর মাদরাসার মাঠে আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর ইমামতিতে মরহুমের জানাজার নামাজ সম্পন্ন হয়। জানাজা শেষে মাদরাসা সংলগ্ন কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। ২০০৪ সালে আল্লামা শাহ শামসুদ্দিনের রহ.-এর ইন্তেকালের পর থেকে নাজিরহাট মাদরাসার মোহতামিমের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন আল্লামা শাহ্ মুহাম্মদ ইদ্রিস।
মাওলানা আনওয়ারুল হক চৌধুরী রহ.
বৃহত্তর সিলেটের সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ আলেম, বালাগঞ্জের হজরত শাহ সুলতান রহ. মাদরাসা এবং মহিলা মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা আনওয়ারুল হক চৌধুরী ১ জুন, সোমবার ভোর ৪টা ৫০মিনিটে সুলতানপুরস্থ নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। ওইদিনই দুপুরে সুলতানপুর মাদরাসা প্রাঙ্গণে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা আনোয়ারুল হক চৌধুরী সিলেটে নারী শিক্ষার প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। প্রচারবিমুখ, সুন্নতের অনুসারী প্রথিতযশা এই প্রবীণ আলেম আমৃত্যু ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে আপামর জনতার মাঝে দ্বীনের প্রচার-প্রসারে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন।
মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ বাশার রহ.
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ বাশার ৮ জুন রাত ১১টায় স্ট্রোক করে মিরপুরস্থ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। তিনি স্ত্রী, ২ পুত্র ও ২ কন্যা রেখে গেছেন। মঙ্গলবার বাদ জোহর মরহুমের জন্মস্থান পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর থানার বড়ইঘনিয়া গ্রামে জানাজার নামাজ শেষে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
মাওলানা কেফায়েত উল্লাহ নূর রহ.
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুফতি নূরুল্লাহ রহ.-এর বড় ছেলে মাওলানা কেফায়েত উল্লাহ নূর ১০ জুন, বুধবার রাত ১০টা ৩০ মিনিটে ব্রাহ্মণবাড়িয়াস্থ ল্যাব এইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। মাওলানা কেফায়েত উল্লাহ নূর নরসিংদী রায়পুরা পান্থশালা মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন। নরসিংদী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় অনেক দ্বীনি খেদমতের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। তিনি সুবক্তা হিসেবে বেশ প্রসিদ্ধ।
এই প্রতিবেদন রচনার সময় সংবাদ আসে, টুমচর ফাজিল মাদরাসার সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল ও লক্ষ্মীপুর চকবাজার জামে মসজিদের সাবেক খতিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস ইন্তেকাল করেছেন। তিনি বিখ্যাত ওয়ায়েজ মাওলানা মুশতাকুন নবীর বাবা। ১৩ জুন, শনিবার ফজরের আগে বার্ধক্যজনিত কারণে ইন্তেকাল করেন তিনি।
এই সময়ের মধ্যে ইন্তেকাল করেছেন দেওবন্দ মাদরাসার শাইখুল হাদিস আল্লামা সাঈদ পালনপুরী। তিনি ১৯ মে সকাল ৭টায় মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। দারুল উলুম দেওবন্দে তিনি প্রায় একযুগ ধরে বোখারি শরিফের দরস প্রদান করেছেন। আরও ইন্তেকাল করেছেন বায়তুশ শরফের পীর মাওলানা কুতুব উদ্দীন। ২০ মে বিকাল ৫টার দিকে ঢাকার আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
উল্লেখিত আলেম ছাড়া আরও অনেক আলেম, মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিনকে আমরা হারিয়েছি। তাদের প্রত্যেকের রুহের মাগফিরাত কামনা করি। দোয়া করি, আল্লাহতায়ালা তাদেরকে বেহেশতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। আমিন।