আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে পরোপকারের জুরি নেই। তাই হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরোপকারের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন। হরজত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরোপকার, মানবসেবা ও সমাজকল্যাণমূলক অবদানের দৃষ্টান্ত সিরাত ও হাদিসের গ্রন্থগুলোতে সবিস্তারে উল্লেখ হয়েছে। এ বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ এবং এর প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) অসংখ্য হাদিস বর্ণনা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ সেই ব্যক্তি, যে মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী।’ -আল মুজামুল আওসাত: ৫৭৮৭
আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে পৃথিবীর বুকে পাঠিয়েছেন। সেই শ্রেষ্ঠত্বের দাবি অনুযায়ী একজন মুসলমান অপর মুসলমানই শুধু নয় সমাজের অন্য মানুষের বিপদে তার পাশে দাঁড়াবে- এটাই ইসলামের অনন্য শিক্ষা।
হজরত জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে লোক মানুষের প্রতি দয়া কিংবা অনুগ্রহ প্রদর্শন করে না, তাকে আল্লাহতায়ালাও দয়া করেননা।’ –সুনানে তিরমিজি: ১৯২২
দুনিয়ায় তো এখন আমরা শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। অন্যকে দেখার সুযোগ কই? মানবতা হারিয়ে গেছে বহু আগে, নি:স্বার্থ কোনো উপকারের কথা ভাবতে কষ্ট হয়। অথচ নবী করিম (সা.) যাকে আমরা নিজেদের আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়েছি, যাকে আমরা অকৃত্রিম ভালোবাসার দাবি করে থাকি, তিনি আমাদের সামনে পরোপকারে এক অনন্য নজির স্থাপন করে গেছেন। আমরা আজ রাসূলের আদর্শকে ছেড়ে অন্য পথে দৌঁড়াচ্ছি; যে পথ কন্টকাকীর্ণ।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহতায়ালা দয়ালুদের ওপর দয়া ও অনুগ্রহ করেন। যারা জমিনে বসবাস করছে তাদের প্রতি তোমরা দয়া করো, তাহলে যিনি আকাশে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। দয়া রহমান হতে উদগত, যে লোক দয়ার সম্পর্ক বজায় রাখে আল্লাহতায়ালাও তার সঙ্গে নিজ সম্পর্ক বজায় রাখেন। যে লোক দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহতায়ালাও তার সঙ্গে দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করেন। -সুনানে তিরমিজি: ১৯২৪
ইসলামে মানবসেবা ও পরোপকারের গুরুত্ব সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে উল্লেখ আছে, রাসূলে করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামত দিবসে নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমার সেবা-শুশ্রূষা করোনি। বান্দা বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আপনি তো বিশ্ব পালনকর্তা, কীভাবে আমি আপনার সেবা-শুশ্রূষা করবো? তিনি বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, অথচ তাকে তুমি দেখতে যাওনি। তুমি কি জানো না, যদি তুমি তার সেবা-শুশ্রূষা করতে, তবে তুমি তার কাছেই আমাকে পেতে? হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে আহার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে আহার করাওনি। বান্দা বলবে, হে আমার রব! তুমি হলে বিশ্ব পালনকর্তা, তোমাকে আমি কীভাবে আহার করাবো? তিনি বলবেন, তুমি কি জানো না যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিলো, কিন্তু তাকে তুমি খাদ্য দাওনি। হে আদম সন্তান! তোমার কাছে আমি পানীয় চেয়েছিলাম, অথচ তুমি আমাকে পানীয় দাওনি। বান্দা বলবে, হে আমার প্রভু! তুমি তো রাব্বুল আলামিন, তোমাকে আমি কীভাবে পান করাবো? তিনি বলবেন, তোমার কাছে আমার অমুক বান্দা পানি চেয়েছিল, কিন্তু তাকে তুমি পান করাওনি। তাকে যদি পান করাতে, তবে নিশ্চয়ই আজ তা প্রাপ্ত হতে।’
অর্ধজাহানের বাদশা হজরত উমর (রা.) রাতের বেলা চলতে চলতে রাজধানীর বাইরে তাঁবুতে একজন লোক দেখলেন। বিষন্ন অবস্থায় বসে আছেন। ভেতরে এক নারীর কাতরানোর শব্দ শুনতে পেয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করলে লোকটি ধমকের সুরে বললো, ‘যাও, যাও, নিজের কাজে যাও। আমাকে জ্বালাতন করো না। হজরত উমর (রা.) পীড়াপীড়ি করাতে লোকটি বললো, তার স্ত্রী প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছে। হজরত উমর (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন, সঙ্গে অন্যকোনো নারী আছে কি? উত্তরে লোকটি বললো, নেই। হজরত উমর (রা.) দ্রুত নিজের ঘরে গিয়ে স্ত্রীকে বললেন, আজ সওয়াব অর্জনের এক বিরাট সুযোগ আল্লাহ দিয়েছেন। এক অচেনা নারী প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছে, প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় নাও এবং আমি কিছু খাবার নিচ্ছি। এই বলে উভয়ে খুব তাড়াতাড়ি সেই তাঁবুর কাছে পৌঁছে স্ত্রীকে তাঁবুর ভেতরে পাঠিয়ে দিলেন এবং নিজে খাবার তৈরি করতে বসে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তাঁবুর ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, আমিরুল মুমিনীন! আপনার বন্ধুকে পুত্র সন্তান হওয়ার সুখবর দিন। আমিরুল মুামিনীন শব্দ শুনতেই লোকটি ঘাবড়ে গেল। হজরত উমর (রা.) তাকে সান্ত্বনা দিলেন। প্রস্তুতকৃত খাবার প্রসূতিকে খাইয়ে বাকি খাবার তাদের হাতে দিয়ে বিবিকে নিয়ে চলে এলেন।’ -তারিখে ত্বাবারী: ৩/২৭৪
এ সব ঘটনা অনেকের কাছে এখন অলিক গল্প মনে হবে। কিন্তু এটাই বাস্তব। মুসলমানদের হারিয়ে যাওয়া সোনালী অতীত এমনই ছিলো।
মুফতি জাওয়াদ তাহের: সিনিয়র শিক্ষক, জামিয়া বাবুস সালাম, বিমানবন্দর, ঢাকা- ১২৩০