সূরা ফাতিহা কোরআনে কারিমের সর্বপ্রথম সূরা। পূর্ণাঙ্গ সূরা হিসেবে এটিই প্রথম নাজিল হয়েছে। এই সূরার আয়াত সংখ্যা ৭। ফাতিহা শব্দের অর্থ আরম্ভ, শুরু, উদ্বোধন ও উদঘাটন প্রভৃতি। ধারাবাহিকতার ভিত্তিতে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে- সূরা ফাতিহা। এটি এ সূরার সর্বাধিক পরিচিত নাম। তারপরও সূরা ফাতিহার স্থান, মর্যাদা, বিষয়বস্তু, ভাবভাষা, প্রতিপাদ্য বিষয় ইত্যাদির বিচারে এর বেশ কিছু নাম রয়েছে এবং প্রত্যেক নামের সঙ্গেই সূরাটির সামঞ্জস্য বিদ্যমান।
সূরা ফাতিহার প্রসিদ্ধ নামগুলো হলো- ১. ফাতিহাতুল কিতাব, ২. সালাত, ৩. আল হামদ, ৪. উম্মুল কিতাব, ৫. উম্মুল কোরআন, ৬. আসসাবউল মাসানি, ৭. কোরআনে আজিম, ৮. আশ-শিফা, ৯. আল আসাস, ১০. আল ওয়াফিয়া, ১১. আল কাফিয়া, ১২. আদ-দোয়া, ১৩. আল কানজ, ১৪. আল মোনাজাত ও ১৫. আত-তাফভিজ।
সূরা ফাতিহা সমগ্র কোরআনের সারসংক্ষেপ
সূরাটি সমগ্র কোরআনের সার সংক্ষেপ। এ সূরায় সমগ্র কোরআনের সারমর্ম সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হয়েছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ভাব ও অর্থের সাগরের বিশাল জলরাশিকে ছোট আয়তনের চৌবাচ্চায় ভরে দিয়েছেন। কোরআনে কারিমের বাকি ১১৩টি সূরা প্রকারান্তরে সূরা ফাতিহারই বিস্তৃত ব্যাখ্যা। কারণ সমগ্র কোরআনে মূলতঃ তিনটি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে।
যেগুলো হলো- আল্লাহতায়ালার পরিচয়, আল্লাহপাকের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি লাভের জন্য মানুষের করণীয় ও বর্জনীয়। সূরা ফাতিহাতে এ তিনটি বিষয় খুব সংক্ষেপে বলে দেওয়া হয়েছে। তাই রূপক অর্থে সূরা ফাতিহা পবিত্র কোরআনের জননী বলে খ্যাত।
সূরা ফাতিহার বিষয়বস্তু
সূরা ফাতিহার সাতটি আয়াতের প্রথম চারটি আয়াতে আল্লাহর প্রশংসা এবং শেষ তিনটি আয়াতে বান্দার প্রার্থনার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, সকল প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর। দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, তিনি দয়াময়, পরম দয়ালু। তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, তিনি কর্মফল দিবসের মালিক। চতুর্থ আয়াতে বলা হয়েছে, আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি, শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। পঞ্চম আয়াতে বলা হয়েছে, আমাদেরকে সরলপথ প্রদর্শন করুন। ষষ্ঠ আয়াতে বলা হয়েছে, তাদের পথ আমাদের দেখাও যাদেরকে তুমি অনুগ্রহ দান করেছ। সপ্তম আয়াতে বলা হয়েছে, তাদের পথ আমাদের দেখিও না, যারা ক্রোধ-নিপতিত ও পথভ্রষ্ট।
সূরা ফাতিহার বৈশিষ্ট্য
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, সূরা ফাতিহা পুর্ণ কোরআনে কারিমের জ্ঞান-ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ। এতে আল্লাহপাকের প্রশংসা করা হয়েছে। ইবাদত এবং একনিষ্ঠতার জন্য বান্দাদের পক্ষ থেকে স্বীকারোক্তি দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ থেকে হেদায়াত প্রার্থনা, নিজের অক্ষমতা স্বীকার করা এবং ওই নিয়ামত প্রতিষ্ঠার ঈমানসমৃদ্ধ বর্ণনা বান্দাদের জবানে এই সূরার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে এই সূরায় পুণরুত্থান দিবস সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যারা ইসলাম এবং কোরআন বিরোধী তাদের পরিণতির ব্যাপারেও আলোকপাত করা হয়েছে।
বিপদ-মুসিবতে সূরা ফাতিহা পড়া খুব উপকার। হজরত আলী (রা.) বলেছেন, কোনো বিপদে পতিত ব্যক্তি এক হাজার বার সূরা ফাতিহা পাঠ করলে ওই ব্যক্তির আর বিপদ থাকতে পারে না।
এ ছাড়া কোরআনের একটি হরফ পাঠ করলে ১০টি নেকি লাভ হয়। সূরা ফাতিহায় ১২৫টি হরফ রয়েছে। ১২৫ হরফ যিনি পাঠ করবেন তার আমলনামায় ১২৫ নেকি দান করা হয়।
সূরা ফাতিহার মাধ্যমে বান্দার সঙ্গে আল্লাহর সঙ্গে প্রেমালাপ হয়
সূরা ফাতিহার বৈশিষ্ট্য বলে শেষ করা যাবে না। এ নামাজে এ সূরা পড়া মানে আল্লাহর সঙ্গে প্রেমালাপ করা। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু হুরাইয়রা (রা.) বলেছেন, তোমরা সূরা ফাতিহা পড়। কোনো বান্দা যখন বলে, আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন, তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করেছে। যখন বলে, আর-রাহমানির রাহিম, তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার গুণ বর্ণনা করেছে। বান্দা যখন বলে, মালিকি ইয়াউমিদ্দিন। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার মর্যাদা বর্ণনা করেছে। বান্দা যখন বলে, ইয়্যাকানাবুদু ওয়া ইয়্যাকানাস্তাইন। আল্লাহ বলেন, এ হচ্ছে আমার ও আমার বান্দার মাঝের কথা। আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে, যা সে চায়। বান্দা যখন বলে, ইহদিনাস সিরাতিল মুস্তাকিম... শেষ পর্যন্ত। আল্লাহ বলেন, এ সব হচ্ছে আমার বান্দার জন্য। আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে, যা সে চায়। -সহিহ মুসলিম: ৩৯৫
সকল রোগ নিরাময়কারী
হজরত আবদুল মালেক ইবনে ওমায়ের (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সূরা ফাতেহা সব রোগের মহৌষধ। -সুনানে দারেমি: ৩৪১৩
মিশকাতের ব্যাখ্যাকার আল্লামা মোল্লা আলী কারী (রহ.) স্বীয় ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘মিরকাতুল মাফাতিহ’ এ উল্লেখিত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, সূরা ফাতেহার অক্ষর, শব্দ পড়াতে যেমন উপকার। তেমনি লেখাতেও উপকার। যেকোনো রকমের রোগ চাই দ্বীনী হোক বা পার্থিব, অনুভবযোগ্য হোক বা না হোক সব কিছু এ সূরার পড়া বা লেখার বরকতে আরোগ্য হবে- ইনশাআল্লাহ।
যেকোনো রোগের জন্য সূরা ফাতিহা পড়ে রোগীর ওপর দম করা যায়। নিশ্চিত এতে আরোগ্য হাসিল হবে। এ জন্যই তো এই সূরাকে সূরাতুর রুকইয়া এবং সূরাতুশ শিফা বলা হয়। হজরত আবু সাঈদ ইবনে মুআল্লা (রা.) হতে বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, নবী করিম (সা.)-এর কিছু সাহাবি এক এলাকায় আগমন করার পর তাদের সরদারকে সাপে কাটল। তারপর সাহাবিদের একজন সূরা ফাতিহা পড়ে তাদের সরদারকে ঝাঁড়ফুক করলে সে সুস্থ হয়ে ওঠে। এর বিনিময়ে সাহাবিগণ বিনিময়স্বরূপ কিছু বকরির পালও লাভ করেন। নবীজি (সা.) এটাকে সমর্থন করেন। আর বললেন, ঠিক আছে বকরিগুলো নিয়ে যাও এবং তাতে আমার জন্যও এক অংশ রেখে দিও। -সহিহ বোখারি: ৫০০৬
অভিজ্ঞ আলেমরা বলেছেন, ৪১ বার সূরা ফাতিহা পাঠ করে পানিতে ফুঁক দিয়ে কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে খাওয়ালে অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ হয়ে যায়। এ জন্য গভীর বিশ্বাস প্রধান শর্ত। কারণ সহিহ আকিদা এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান ছাড়া কিছুই অর্জন হবে না।
এ সূরায় আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি এবং সব রকমের সাহায্য আল্লাহর কাছে চাওয়ার যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এর ওপরও আমল এবং বিশ্বাস অত্যন্ত জরুরি।
মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী: মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ