সাহায্য প্রদানে কোনো লৌকিকতা নয়

বিশেষ নিবন্ধ, ইসলাম

ফয়সল আহমদ জালালী, অতিথি লেখক, ইসলাম | 2023-08-31 13:13:58

মানুষ যে দুর্বল ও অসহায়, তা আবারও প্রমাণিত হল। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস দ্বারা মানবজাতি হুমকির মুখে। কে কখন আক্রান্ত হয়, সেই চিন্তায় বিশ্ব মানব তটস্থ। দৈনিক হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর সংবাদ আসছে সংবাদ মাধ্যমে। সুপার পাওয়ার ও স্বাস্থ্যসেবায় উন্নত তকমাধারীসহ কাউকেই ভাইরাস তোয়াক্কা করেনি। আস্তিক-নাস্তিক, মুসলিম-অমুসলিম, পাপী-পাপমুক্ত কাউকেই সে আলাদা করেনি। এ বিষয়ে যারা ইতোপূর্বে নানা বক্তব্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল, সেসব ইসলামের আলোকে যথাযথ ছিল না। বাস্তবেও যে তা সত্য নয়, এটা প্রমাণ হলো।

মহামারি থেকে আত্মরক্ষার কৌশল অবলম্বন করতে গিয়ে বিশ্বে লকডাউন নীতি অবলম্বন করা হয়েছে। ‘জান বাঁচানো ফরজ’ বলে সমাজে প্রচলিত বচনটি অমূলক নয়। এটি কোরআন-সুন্নাহ সমর্থিত। আলোচ্য নিবন্ধে এ বিষয়ে আলোচনা উদ্দেশ্য নয়। আজকের আলোচনা করোনার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটকালে আমাদের করণীয় সম্পর্কে।

অভাব গ্রস্তকেকে আহার দান
মানুষের যাতায়াত নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় শ্রমজীবী, পেশাজীবী, কৃষিজীবী ও দিন মজুর ইত্যাদি সব শ্রেণির মানুষের আয়-উপার্জন বন্ধ। এমতাবস্থায় এক শ্রেণির মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন যাপন করছে। বিত্তশালী, কল-কারখানার মালিক ও সরকারি আধা সরকারি কিংবা প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিতে চাকুরিরতদের জীবিকা নির্বাহের পথ সুগম। এর বাইরে হাতেগোণা কিছু মানুষ ছাড়া সাধারণ মানুষের জীবন আজ বিপন্ন। অভাব অনটনের খড়গ এদের ওপর দিয়ে যাচ্ছে।

দেশ ও সমাজ অভাব-অনটনের সম্মুখীন হলে সচ্ছল মানুষদের কর্তব্য হলো- অসহায়-অসচ্ছলদের প্রতি দানের হাত প্রসারিত করা। মহান আল্লাহ সেই সব মুমিনের প্রশংসা করেছেন যারা দুর্দিনে অভাবি মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসে আর বিপদের কঠিন মুহূর্তে ধৈর্যধারণের পরামর্শ দেয়। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে অন্নদান, এতিম আত্মীয়কে, অথবা ধূলি-ধূসরিত মিসকিনকে, অতঃপর তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, যারা ঈমান আনে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় সবরের ও উপদেশ দেয় দয়ার। তারাই সৌভাগ্যশালী।’ –সূরা বালাদ: ১৪-১৮

অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদানে উৎসাহ না দিয়ে এবং এতিমকে অবমূল্যায়ন করে যারা সম্পদের মোহে বিভোর থাকে আল্লাহতায়ালা তাদের কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘না, কখন্ও নয়; বরং তোমরা এতিমকে সম্মান করো না, অভাবগ্রস্তদেরকে খাদ্যদানে পরস্পরকে উৎসাহিত করো না, উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য সম্পদ সম্পূর্ণরূপে খেয়ে ফেল, ধনসম্পদ অতিশয় ভালোবাসো- তা সংগত নয়।’ –সূরা ফাজর: ১৭-২১

অভাবগ্রস্তকে অন্নদানে এগিয়ে না আসা। এ ব্যাপারে মানুষদের অনুপ্রাণিত না করা- এতই গর্হিত কাজ, যাকে সৃষ্টিকর্তা পরকালের কর্মফলকে অস্বীকার করার পর্যায়ভুক্ত বলে সূরা মাঊনে ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি কি দেখেছ তাকে, যে দীন তথা কর্মফলকে অস্বীকার করে। সে তো সে-ই যে এতিমকে রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয় এবং অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দানে উৎসাহ দেয় না।’ –সূরা মাঊন: ১-৩

অভাবগ্রস্তকে খাবার না দেওয়ায় জাহান্নাম
শেষ বিচারের দিন একদল মানুষকে আল্লাহ্তায়ালা ‘সাকার’ নামক জাহান্নামে দেখে তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা এখানে কেন? তারা এর উত্তরে যা বলবে কোরআনে কারিমের ভাষায় তা শুনুন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমাদেরকে কিসে সাকার এ নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে, আমরা মুসল্লিদের (নামাজি) অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। আমরা অভাবগ্রস্তকে আহার্য দান করতাম না।’ –সূরা মুদ্দাসসির: ৪২-৪৪

ফেরেশতাদের প্রতি মহান আল্লাহ কিয়ামত দিবসে যে নির্দেশনা দেবেন তা যে কত কঠোর হবে- আসুন! তা আল্লাহর কালাম থেকেই জেনে নেই। ইরশাদ হচ্ছে, ‘ফেরেশতাদের বলা হবে, ধরো একে, গলায় বেড়ি পরিয়ে দাও, অতঃপর নিক্ষেপ করো জাহান্নামে। অতঃপর তাকে শৃঙ্খলিত করো সত্তর গজ দীর্ঘ এক শিকলে; নিশ্চয় সে মহান আল্লাহতে বিশ্বাসী ছিলো না এবং মিসকিনকে আহার্য দিতে উৎসাহিত করতো না।’ –সূরা আল হাক্কা: ৩০-৩৪

‘আল্লাহকে অন্নদান ও তার সেবা’
অন্নহীনকে অন্নদান ও রোগীর সেবা দান অতুলনীয় ফজিলতময় কাজ। এর মর্যাদা এমন উচ্চাঙ্গের যে আল্লাহ্তায়ালা স্বয়ং তাকেই খাবার দেওয়া এবং তাকেই সেবা-শুশ্রূষা দানের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন। হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত, ‘হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ্তায়ালা কিয়ামত দিবসে বলবেন, ওহে আদম সন্তান! আমি পীড়িত ছিলাম তুমি আমাকে সেবা দিলে না। প্রশ্ন শুনে আল্লাহর বান্দা বিস্মিত হয়ে যাবে। বলবে, ওহে আমার রব! আপনি গোটা জাহানের মালিক, আপনার সেবা করব কিভাবে? আল্লাহ্তায়ালা বলবেন, আমার অমুক বান্দাটি অসুস্থ ছিলো, তুমি তার সেবা করোনি। যদি তুমি তার সেবা করতে তাহলে আজ আমার কাছে সেই মর্যাদা পেতে। অন্য একজন কে বলবেন, ওহে আমার বান্দা! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম তুমি আমাকে খাবার দাওনি। সেও বিস্মিত হবে আর বলবে, ওহে আমার রব! আপনি গোটা জাহানের মালিক, আপনাকে খাবার দেবো কিভাবে। আল্লাহ্তায়ালা বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, তুমি তাকে খাবার দাওনি। সেদিন যদি তুমি তাকে খাবার দিতে তা হলে আজ আমার কাছে সেই মর্যাদা পেতে। আরও একজনকে বলবেন, ওহে আমার বান্দা! আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে পানি দাওনি। সেও বিস্মিত হয়ে বলবে, ওহে আমার রব! আপনি গোটা জাহানের মালিক আপনাকে পানি দেবো কিভাবে? আল্লাহ্তায়ালা বলবেন, আমার অমুক বান্দাটি তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, তুমি তাকে পানি দাওনি। সেদিন যদি তুমি তাকে পানি দিতে তাহলে আজ আমার কাছে সেই মর্যাদা পেতে।’ –সহিহ মুসলিম: ৪৬৬১

প্রতিবেশীকে গুরুত্ব দেওয়া
আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিবেশীকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। ‘তিনি বলতেন, হজরত জিবরাঈল (আ.) আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে এ পরিমাণ সতর্ক করতেন যে, আমার মনে হত এক সময় তাকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার ঘোষণা করে দেবেন। তিনি তার এক বাণীতে হুঁশিয়ার করে বলেন, আল্লাহ্ ও পরকালে যার বিশ্বাস রয়েছে সে যেন প্রতিবেশীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে।’ –সহিহ বোখারি: ৬০১৯

হজরত আনাস ইবন মালেক (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সেই ব্যক্তি আমার ওপর বিশ্বাসই স্থাপন করেনি, যে তার প্রতিবেশীকে অভুক্ত জেনেও সে খেয়ে দেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে রাতযাপন করে।’ তাবরানি আল মুজামুল কাবির

মানব সেবায় মহানবী সা.
মহানবী (সা.) ছিলেন বিশ্ববাসীর প্রতি আল্লাহর শ্রেষ্ঠ উপহার। ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। তার চরিত্র মাধুরীর কিছু দিক নবুওয়ত লাভের ঊষালগ্নে তুলে ধরেছেন তার স্ত্রী হজরত খাদিজা (রা.)। নবী করিম (সা.) যখন প্রথম অহির ভার বহন করতে নিজের প্রাণের ব্যাপারে আশংকা প্রকাশ করছিলেন, তখন খাদিজা (রা.)- তাকে অভয় দেন এভাবে- ‘আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেন, অপরের বোঝা বহন করেন। সম্বলহীন মানুষকে সম্বল দান করেন। মেহমানকে আপ্যায়ন করেন, প্রকৃত বিপদগ্রস্তের সাহায্যে এগিয়ে আসেন।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম

সাহায্য প্রদানে লৌকিকতা নয়
যেখানে অন্য কাউকে উৎসাহ দান উদ্দেশ্য হয় না, সেখানে যেকোনো ধরনের দান-সদকায় গোপনীয়তা রক্ষা করা উত্তম। শুধু উত্তমই না অতিউত্তম। ‘নবী করিম (সা.) সাত শ্রেণির মানুষকে কিয়ামত দিবসে আল্লাহর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এ সাত শ্রেণির অন্যতম হলো, যে ব্যক্তি সদকা-দানে এমনভাবে গোপনীয়তা রক্ষা করে তার ডান হাতে কি দিল বাম হাত তা বুঝতে পারে না।’ –সহিহ বোখারি

গ্রহীতা থেকে বিনিময় প্রত্যাশা নয়
সাধারণ দান হোক আর সদকা হোক, এর বিনিময় প্রাপ্তি কেবল মহান আল্লাহর কাছে উদ্দেশ্য হতে হবে। গ্রহীতা থেকে প্রতিদান প্রত্যাশা করলে দানের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। অনেকে উপহার দেয় এই উদ্দেশ্য যে পরবর্তীতে তার কোনো অনুষ্ঠানে সমপরিমাণ বা এরচেয়ে বেশি পাবে। কোরআনে কারিমে এমন দানকে সুদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। -সূরা রূম: ৩৯

সমাজের ব্যাপক সংখ্যক মানুষ দান করার পর গ্রহীতাদের কাছে দোয়া চায়, সেটিও কাম্য নয়। এটাও দানের বিনিময় চাওয়া। কোরআনে সৎকর্মশীল জান্নাতিদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘খাবারের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দীকে খাবার দান করে এবং বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে আহার দান করি, আমরা তোমাদের নিকট হতে প্রতিদান চাই না,কৃতজ্ঞতা ও নয় ।(সূরা-দাহর ,আয়াত-৮-৯) তবে খাওয়া দাওয়ার পর যদি মেহমান স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনো দোয়া করেন তাতে কোনো দোষ নেই। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) খাদ্য গ্রহণ শেষে কোনো কোনো সময় আপ্যায়নকারীকে জিজ্ঞেস করতেন, তোমার জন্য কোনো দোয়া করবো? সে যা চাইত সেটি তার জন্য কল্যাণকর মনে করলে, সেই দোয়া তিনি তার জন্য করতেন।

গ্রহীতা কর্তৃক ‘জাযাকাল্লাহ’ বলা
‘জাযাকাল্লাহ খাইরা’ মানে আল্লাহ তোমাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ গ্রহীতার কর্তব্য। সে তা পালন না করলে সেটি তার অপরাধ। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে তিনি অবশ্যই বৃদ্ধি করে দেবেন। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মানুষের নিকট থেকে প্রাপ্তির বিষয়টিকে যেব্যক্তি স্মরণে রাখে না সে যেন আল্লাহর শোকরিয়া করল না। হজরত উসামা ইবন যায়দ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, যার প্রতি কোনো সৎকর্ম করা হয় সে যদি কর্তার উদ্দেশ্যে বলে, ‘জাযাকাল্লাহ খাইরা’ তা হলে সে উত্তমভাবে তার শোকরিয়া করলো। -সুনানে তিরমিজি: ২০৩৫

কোনো কিছু গ্রহণকালে গ্রহীতার যে কিছু বলতে হয়, আমাদের সমাজে তার প্রচলন নাই বললেই চলে, অনেকে এটা ভুলেও গেছে। আসুন, অঅমরা ‘জাযাকাল্লাহ’ বলার সংস্কৃতি আমরা চালু করি।

ফয়সল আহমদ জালালী: সিনিয়র মুহাদ্দিস, দারুল উলূম মিরপুর- ১৩, ঢাকা

এ সম্পর্কিত আরও খবর