অন্যের দোষত্রুটি অন্বেষণ, পরচর্চা, মুমিনের গিবত, বিদ্রূপ করা ও একের কথা অন্যের কাছে বলে বেড়ানো এবং সম্পদ জমাকারীদের নিন্দা করা হয়েছে কোরআনে কারিমে।
সূরা হুমাযা। পবিত্র কোরআনের একশ চারতম সূরা। ৯ আয়াতবিশিষ্ট এ সূরাটি নাজিল হয়েছে মক্কায়। সূরা হুমাযার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যায় এ সব কথা বলেছেন ইসলামি স্কলাররা।
এ ছাড়া এই সূরায় এই শ্রেণির লোকদের জন্য নির্ধারিত জাহান্নামের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এই শ্রেণির লোকদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক পরিণতি এবং তাদেরকে অপমানজনকভাবে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আর জাহান্নামের আগুন সবকিছুর আগে তাদের হৃদয়ের ওপর চেপে বসবে এবং তাদের প্রাণ ও আত্মাকে পুড়তে থাকবে।
কোরআনে কারিমে অনেক ব্যাখ্যাকার মনে করেন সূরা হুমাযা নাজিল হয়েছে ওলিদ বিন মুগিরা সম্পর্কে। এই লোকটি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্পর্কে তার অনুপস্থিতিতে অপপ্রচার চালাতো এবং তার সামনে ও পেছনে উপহাস করত।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, এই সূরা নাজিল হয়েছিল কঠোর ইসলামবিদ্বেষী আখনাস বিন শারিক, উমাইয়া বিন খালাফ ও আস বিন ওয়ায়েল সম্পর্কে। তবে এটা স্পষ্ট যে, সবযুগের নিন্দুক, বিদ্রূপকারী, গিবতকারী ও চোগলখোর শ্রেণির সব মানুষের জন্য প্রযোজ্য সূরা হুমাযার বক্তব্য।
সূরা হুমাযার অনুবাদ হলো- পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। ১. প্রত্যেক পশ্চাতে ও সম্মুখে নিন্দাকারীর দুর্ভোগ, ২. যে অর্থ সঞ্চিত করে ও গণনা করে, ৩. সে মনে করে, তার অর্থ চিরকাল তার সঙ্গে থাকবে, ৪. কখনও না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে পিষ্টকারীর মধ্যে, ৫. আপনি কি জানেন, পিষ্টকারী কি? ৬. এটা আল্লাহর প্রজ্বলিত অগ্নি, ৭. যা হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছবে; ৮. এতে তাদের বেঁধে দেওয়া হবে, ৯. লম্বালম্বি খুঁটিতে।
হুমাযা শব্দটি এসেছে ভাঙা শব্দটি থেকে। গিবতকারী ও ছিদ্রান্বেষণকারীরা অন্যদের ব্যক্তিত্বকে ভেঙে চুরমার করে বলে এই শ্রেণির লোকদের হুমাযা বলা হয়। লুমাযা শব্দের অর্থও একই ধরনের।
সূরা হুমাযার প্রথমে বলা হয়েছে, ধ্বংস ও দুর্ভোগ প্রত্যেক বিদ্রূপকারী ও নিন্দাকারীর জন্য! বস্তুত গিবত ও চোগলখুরির ফলে মানুষের মধ্যে হিংসা-প্রতিহিংসা এবং শত্রুতা ছড়িয়ে পড়ে। যারা নানা ধরনের অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে অন্যকে বিদ্রূপ ও উপহাস করে এবং অপবাদ দেয় তাদের প্রতি কড়া হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে এই সূরায়। সূরা হুমাযার বক্তব্য অনুযায়ী যারা সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে, তাদের মধ্যে জেগে ওঠে নানা ধরনের মন্দ স্বভাব। যেমন, অন্যদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা। তাই ব্যাপক সম্পদের অধিকারী হয়ে কেউ যেন অহঙ্কার ও গর্বের ফাঁদে না পড়ে, সে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।
ছিদ্রান্বেষণও এমন এক জঘন্য স্বভাব, যা কোরআনে কারিমের বিভিন্ন স্থানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং ছিদ্রান্বেষীকে তিরস্কার করা হয়েছে। সম্পদশালীদের অনেকেই ভাবেন, সম্পদ থাকলেই তারা অমর হয়ে যাবেন, অসুস্থ হলে টাকা খরচ করে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশেষ করে এই করোনা পরিস্থিতি মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, টাকা-পয়সা সব কিছু নয়।
মানুষের মন্দ ও ভালো চিন্তা আর কাজ তার নিজের ওপর ও অন্যদের ওপর প্রভাব ফেলে। ছিদ্রান্বেষণ হচ্ছে এমন এক রোগ, যা ছিদ্রান্বেষীসহ অন্যদের ওপর বিষাক্ত প্রভাব ফেলে। ছিদ্রান্বেষীকে খুব মন্দ পরিণতির শিকার হতে হয়। এ ধরনের মানুষ কলঙ্কিত হয়।
মুমিনের সম্মান মহান আল্লাহর কাছে খুব প্রিয়। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের সম্মানকে হিংসুক ও দুর্মুখ লোকদের মাধ্যমে বিপদাপন্ন হতে দেন না। ফলে পরকালের কঠোর শাস্তি ছাড়াও দুনিয়ার জীবনেই ছিদ্রান্বেষীদের কলঙ্কিত করেন মহান আল্লাহ। একাধিক হাদিসের সারমর্মে বলা হয়েছে, মুমিনদের দোষত্রুটির সন্ধান করো না। কারণ যে তার ভাইয়ের দোষত্রুটির সন্ধান করে, মহান আল্লাহ তার দোষত্রুটি খোঁজেন ও সেসব অন্যদের কাছে প্রকাশ করে তাকে কলঙ্কিত করেন- যদিও সে ঘরের ভেতরেই থাকে।
পবিত্র কোরআনে মানুষের দোষত্রুটি ও সেসব সংশোধন এবং নির্মূলের উপায় নিয়ে অনেক আলোচনা রয়েছে। কোন্ কোন্ স্বভাব, প্রথা ও আচার-আচরণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর ও দূষণীয় তা উল্লেখ রয়েছে কোরআনে কারিমে। পবিত্র কোরআন পরচর্চা, অশালীন কথা বলা, গালি দেওয়া, উপহাস করা, মিথ্যা বলা, অসহিষ্ণুতা, কার্পণ্য ও অজ্ঞতার মতো নানা মন্দ স্বভাবের কথা উল্লেখ করে এসব মন্দ স্বভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে এবং এগুলোকে নির্মূল করতে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- মানুষের উচিত নিজের বদস্বভাব ও ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো শনাক্ত করা এবং সেগুলো দূর করার ব্যাপারে আন্তরিক হওয়া। এটাই এই সূরার মূল শিক্ষা ও দাবি।