অকারণে জীব হত্যা ইসলামে অন্যায়। ভালোবাসা দিয়ে প্রাণীর লালন-পালনের শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। প্রাণীর প্রতি কোনো নির্যাতন করা চলবে না। জগতের সকল জীবের প্রতি প্রীতি প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি বলেছেন, জগতের সব প্রাণীর প্রতি তোমরা করুণা প্রদর্শন করো আকাশের মালিক তোমাদের প্রতি করুণা করবেন। -সুনানে তিরমিজি: ১৯৩০
সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ মানুষের প্রয়োজনের অধীন করেছেন সৃষ্টির সব কিছু। বলেছেন, তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। -সূরা বাকারা: ২৯
মানুষ প্রয়োজনে বিশ্ব জগতের সব কিছু ব্যবহার করবে। কারণ মানুষের জন্য বিশ্ব জগৎ আর মানুষ পালনকর্তার জন্য। স্রষ্টার বিধান মেনে মানুষ তার প্রয়োজন মেটাবে, এটিই নিয়ম। ‘জীব হত্যা মহাপাপ’ এসব সস্তা বুলি। বিশ্ব সমাজের ভারসাম্য রক্ষায় তা অচল। বৈরাগ্যবাদ লোকালয়ে চলে না। বন জঙ্গলের সীমানায় ও এরূপ মতবাদ অচল। নিরামিষ ভোজী! সেতো তরকারি শাক-সবজির সমাহার। এগুলো প্রাণহীন? না, এগুলোর ও প্রাণ আছে। তারাও আল্লাহর নাম জপ করে। তাতো সৃষ্টিকর্তার কথা। প্রাণ না থাকলে জপ করে কিভাবে। আধুনিক বিজ্ঞান বিষয়টি খোলাসা করে দিয়েছে। বলছে, উদ্ভিদের ও প্রাণ আছে। রাব্বুল আলামীনের ঘোষণা, হিংস্রজাত পশু ছাড়া তোমাদের জন্য চতুষ্পদ জীবকে হালাল করা হয়েছে। -সূরা মায়িদা: ১
সৃষ্টি যার তিনিই যেখানে বৈধ করেছেন সেখানে অতি সন্ন্যাসী সাজার কি আছে?
জবাই হবে আল্লাহর নামে
পশু জবাই করতে হবে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নামে। প্রাণীর প্রতি আমার যথেষ্ট প্রেম আছে। আছে ভালোবাসাও। আমার যেমন প্রাণ তারও সেরকম প্রাণ। প্রাণ আমার হোক আর পশুপাখির হোক, আল্লাহর নামের কাছে তা কিছুই নয়। কারণ আমাদের জীবন-মরণ সব আল্লাহর জন্য। ইসলাম ফিতরাতের ধর্ম। মানুষের নাড়ি বুঝে এর বিধান দেওয়া হয়েছে। এতে নেই কোনো প্রাণীপূজা আর নেই কোন প্রাণীর সাজা। আমার মালিক আর প্রাণীর মালিক একজনই। এক কথায় বিশ্ব জাহানের অধিপতি হলেন আল্লাহ। আমার জন্য তার গোশত হালাল করেছেন তিনিই। আমরা তারই হুকুমের অধীন। তার নামেই প্রাণীকে আমরা হালাল করি। বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার হলো হালদারের মন্ত্র। এর ওপরে আর কোনো করুণা দেখানো হবে ভণ্ডামি। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশির মতো।
হজরত আদম আ.-এর ছেলেদের কোরবানি
যুগে যুগে আল্লাহর নামে প্রাণী উৎসর্গ করার প্রচলন ছিল। আমরা যাকে কোরবানি বলি। আদি মানব হজরত আদম আলাইহিস সালামের দুই পুত্র কোরবানি করেছিলেন। ইরশাদ হয়েছে, আদম দু’পুত্রের বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শোনাও। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল....। -সূরা আল মায়েদা:২৭
হজরত ইবরাহিম আ.-এর কোরবানি
হজরত ইবরাহিম আলাইহিস আলাইহিস সালামের কোরবানি ছিলো মহা এক পরীক্ষা। আল্লাহর পক্ষ হতে পুত্রকে কোরবানি করার আদিষ্ট হন তিনি। রবের পক্ষ হতে আদেশপ্রাপ্তির পর আল্লাহর নামে উৎসর্গ করতে আর হতে সামান্যতম ও কুন্ঠাবোধ করেননি পিতা ও পুত্র। মূর্তিমান সহনশীল এই পুত্র ছিলেন ইসমাঈল আ.। তখন তিনি ছিলেন পিতার একমাত্র সন্তান। সেই পরীক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে একটি দুম্বা কোরবানির মাধ্যমে। মুহাম্মাদ সা. তার ঊর্ধ্বতন পুরুষ ইবরাহিম আ.-এর অনুকরণে সেই কোরবানির বিধান চালু রাখেন। সাহাবায়ে কিরামের প্রশ্নের উত্তরে হজরত রাসূলুল্লাহ সা. বলেছিলেন, এটি তোমাদের পূর্ব পুরুষ ইবরাহিম প্রবর্তিত রীতি।
মিল্লাতে ইবরাহিম
তাওহিদ তথ্য এক আল্লাহর বিশ্বাসে বলীয়ান ছিলেন হজরত ইবরাহিম আ.। শিরক ও মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে ছিল তার কঠোর অবস্থান। এ কারণে তাকে অগ্নিকুণ্ডেও নিক্ষিপ্ত হতে হয়েছিল। হজরত ইবরাহিম আ.-এর পরবর্তী নবীগণ ছিলেন তারই বংশজাত। ইসমাঈলি ধারার একমাত্র নবী হলেন মুহাম্মাদ সা.। বাকী সবাই ইসরাঈলি ধারার। বর্তমান বিশ্বে হজরত মূসা আ., হজরত ঈসা আ. ও মুহাম্মাদ সা.-এর অজস্র অনুসারী রয়েছেন। পশ্চিমা ঐতিহাসিকগণ এই তিন নবীর ধর্মকে ইবরাহিমি ধর্ম বলে অভিহিত করেন। ইসলামের নবী মুহাম্মাদ সা. তাদেরকে আল্লাহর রাসূল ছিলেন বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। শুধু স্বীকৃতিই নয়, তাদেরকে আল্লাহ্ কর্তৃক প্রেরিত বলে বিশ্বাস করাকে ঈমানের অন্যতম অঙ্গ বলে ঘোষণা করেছেন। অথচ ইহুদি ও খ্রিস্টানরা হজরত ইসমাঈল আ.-এর স্মৃতি বিজড়িত কোরবানির বিষয়টিও মানতে নারাজ। এখানে হজরত ইসহাক আ. কে তারা লক্ষ্য বানাতে চান। অথচ ঐতিহাসিক মক্কা-মোকাররামায় ইবরাহিম ও ইসমাঈল স্মৃতিবিজড়িত নিদর্শনাবলী এখনও অক্ষত। মিনা প্রান্তরে তাদের কোরবানিতে যাত্রাস্থলের পয়েন্টগুলো সুরক্ষিত। তা চোখে দেখার মতো বিশ্বাসযোগ্য। দুম্বা কোরবানির মাধ্যমে যার পরিসমাপ্তি ঘটে। পাহাড়ের টিলার ওপর তার স্মৃতিস্বরূপ একটি স্তম্ভও রয়েছে।
সূরা সাফফাতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। সে যখন পিতার সঙ্গে দৌঁড়ঝাপের বয়সে পৌঁছল, তিনি বললেন, খোকা! আমি স্বপ্ন দেখি তোমাকে জবেহ করছি। এতে তোমার অভিমত কি। ছেলে বলল, আব্বু! আপনি আদেশ পালন করুন। আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন- ইনশাআল্লাহ। দু'জন আনুগত্য প্রকাশ করল আর পুত্রকে কাত করে শোয়াল। আমি তখন ডেকে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমি স্বপ্নাদেশ পালন করেছ। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটি ছিল এক মহাপরীক্ষা। আমি তাকে মুক্তি দিলাম এক কোরবানির বিনিময়ে। -সূরা আস সাফফাত: ১০১-১০৭
হজরত রাসূলুল্লাহ সা.-এর কোরবানি
হজরত রাসূলুল্লাহ সা. ছাগল, ভেড়া ও গরু কোরবানি করেছেন। কোনো সময় নিজেই নিজের কোরবানি করেছেন। কোনো সময় সহধর্মিণীগণের পক্ষে এবং কোনো সময় উম্মাহর পক্ষ থেকে ছিল তার কোরবানি। প্রাণীকুলের প্রতি ছিল তার অকুণ্ঠ ভালোবাসা। তবে আল্লাহর ভালোবাসার কাছে দুনিয়ার সব ভালোবাসা তার কাছে ছিল পরাজিত। তাই নিজ হাতে তিনি পশু কোরবানি করেছেন।
হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন, আমি ঈদগাহে হজরত রাসূলুল্লাহ সা.-এর সঙ্গে ছিলাম। খুৎবা শেষে তিনি মিম্বর থেকে অবতরণ করলে তার কাছে একটি ভেড়া নিয়ে আসা হল। তিনি তা নিজ হাতেই জবাই করলেন। -সুনানে তিরমিজি: ১৫২১
যারা গরুর অতিমাত্রায় ভক্ত, তারা বলতে চান- ইসলামের নবী গরুর গোশত খান নাই। অথচ হজরত রাসূলুল্লাহ সা. গরু জবাই করেছেন, এমনকি গরুর কোরবানিও দিয়েছেন। উম্মত জননী হজরত আয়েশা রা. বলেন, আমরা মিনায় অবস্থানকালে আমাদের কাছে গরুর গোশত নিয়ে আসা হলো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এটি কী। লোকজন বলল, হজরত রাসূলুল্লাহ সা. একটি গরু তার সহধর্মিণীগণের পক্ষে কোরবানি দিয়েছেন। এটি ছিল বিদায় হজের ঘটনা। এরপর তিনি আর কোরবানি করার সুযোগ পাননি। -সহিহ বোখারি: ৫২২৮ৎ
আমরা পরিবেশবাদী হই আর পশুপাখি প্রেমিক হই কিংবা গোপূজারী হই, সবাইকে মনে রাখতে হবে; আমরা মহান আল্লাহর গোলাম। গোলামের কাজ মনিবের দাসত্ব করা। যিনি বিশ্বজগতের মালিক তিনি যেনতেন মনিব নয়। তিনি খাদ্য ও আলো বাতাস দিয়ে গোটা জগত পালন করেন। তার আদেশের সামনে মাথা নত করার মাঝে রয়েছে গোটা জগতের কল্যাণ। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন তোমার রবের জন্য সালাত আদায় করো এবং কোরবানি করো। -সূরা কাওসার
নিবেদিত মনে কোরবানি
আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত পথে, হজরত ইবরাহিম আ. প্রদর্শিত ও মুহাম্মাদ সা. সমর্থিত কোরবানি একান্ত নিবেদিত মনে হতে হবে। এতে কোরবানি নামের ত্যাগ আমাদের জীবনে স্বার্থকতা নিয়ে আসবে। কোরবানি প্রদর্শনীর মহড়া নয়। নয় মুখ রক্ষার কোনো অনুষ্ঠান। ভূরিভোজের কোনো আয়োজনও নয়। দেহ, মন ও অর্থকে সম্পূর্ণরূপে পালনকর্তা আল্লাহর নামে বিসর্জন দেওয়ার নাম কোরবানি। এমনটি হলে পশুর লোম লোমে অর্জিত হবে পুণ্য। আল্লাহ তার গোলামের মনের ভাব দেখতে চান। তার কাছে পশুর কোনো গোশত ও শোণিতের কোনো মূল্য নেই। বান্দা কি মনে ও কোন বিশ্বাস নিয়ে কোরবানি করছে সেটি মূল্যায়ন করেন আল্লাহ ।
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোরবানি করার সময় বলতেন ইন্নি ওয়াজ্জাহতু... আমি আমাকে মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তার সামনে সোপর্দ করলাম। শেষে বলতেন, ওহে আল্লাহ্! ইবরাহিম খলিল হতে যেভাবে কবুল করেছো- সেভাবে আমাদের থেকে কবুল করো।
আল্লাহর মহব্বতে বিলীন হয়ে ইবরাহীম আ.-এর ঘোষণা ছিলো- আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ মহাবিশ্বের পালনকর্তার জন্য নিবেদিত। -সূরা আনআম: ১৬২
লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস ও গবেষক ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ