১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে দিনটিতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।
ফলে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের বছরে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসটি উপলক্ষে সোমবার (১০ জানুয়ারি) কলকাতাস্থিত বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন প্রাঙ্গণে নবনির্মিত বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য, ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, এমপি।
অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন উপ-হাইকমিশনার তৌফিক হাসান ও সকল কর্মকর্তাবৃন্দ।
কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য উদ্বোধন করে মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ উপ হাইকমিশন, কলকাতা তাদের মিশন প্রাঙ্গণে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি আবক্ষ ভাস্কর্য নির্মাণ করেছে জেনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।
বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় কলকাতায় অতিবাহিত করেছেন। বর্তমান মৌলানা আজাদ কলেজ অর্থাৎ তৎকালীন ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৫-৪৬ শিক্ষাবর্ষে বেকার গভর্নমেন্ট হোস্টেলের ২৪ নম্বর কক্ষে আবাসিক ছিলেন। যেটি এখন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কক্ষ হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু
১৯৪৬ সালে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে মুসলিম লীগের তরুণ কর্মী হিসাবে পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে ভারতবর্ষ চষে বেড়িয়েছেন। তরুণ মুজিব, জীবনবাজি রেখে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার মাঝখানে দাঁড়িয়েছেন মানবঢাল হিসাবে।
১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ - তারুণ্যের ছয়টি বছর কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সক্রিয়তা খুব সহজেই তাকে পরিচিত করে তোলে, বৃহত্তর বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে। শহীদ সাহেবের স্নেহভাজন হিসাবে শেখ মুজিব হয়ে উঠেন কলকাতায় মুসলিম লীগের প্রভাবশালী ছাত্রনেতা। কলকাতার অভিজ্ঞতা বঙ্গবন্ধুর অসামান্য নেতৃত্বগুণকে বিকশিত করতে সহায়তা করে।
এরপর ড. মোমেন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতের সহযোগিতার স্মৃতিচারণ করার পর বলেন, ১৯৭১ এর ১৮ ই এপ্রিল তৎকালীন কলকাতার মিশন প্রধান জনাব হোসেন আলী বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে মিশনের অন্যান্য বাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেন। সেইদিন থেকে কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশন বিদেশে বাংলাদেশের প্রথম কূটনৈতিক মিশন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং সেই ঐতিহাসিক ভবনটি আজও বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন হিসেবে স্বমহিমায় বিরাজমান। প্রতি বছর ১৮ ই এপ্রিল তারিখে বাংলাদেশে “ফরেন সার্ভিস ডে” হিসেবে পালিত হচ্ছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাই কলকাতার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তাঁর কলকাতায় যাত্রা বিরতি করার কথা ছিল। কিন্তু দেশমাতৃকার টানে বঙ্গবন্ধু দিল্লী থেকে সোজা ঢাকায় অবতরণ করেন এবং কলকাতায় শীঘ্রই আসবেন বলে কলকাতার আকাশে বিমান থেকেই কলকাতায় বার্তা পাঠান। তাঁর সেই কথা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা সফর করেন এবং ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার বিখ্যাত ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ডে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর উপস্থিতিতে প্রায় ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে বক্তব্য রাখেন। সেইসময় বঙ্গবন্ধু কলকাতার ঐতিহাসিক বাংলাদেশ উপ হাইকমিশন ভবনটি সফর করেন এবং মিশনের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। বহির্বিশ্বে স্থাপিত বাংলাদেশের প্রথম কূটনৈতিক মিশনে জাতির পিতার সেদিনের উপস্থিতি এক অন্যরকম তাৎপর্যপূর্ণ আবহ সৃষ্টি করেছিল।
এ বছর আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি এবং একইসাথে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীরও ৫০ বছর পূর্তি উদযাপিত হচ্ছে। এরকম একটি সময়ে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অসংখ্য স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহ্যবাহী শহর কলকাতায় বাংলাদেশ উপ হাইকমিশন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এজন্য আমি মিশনের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। এ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত সবাইকে জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা। এটি আমাদের জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসারই একটি চমৎকার নিদর্শন হিসেবে থেকে যাবে চিরদিন।
প্রসঙ্গত, কলকাতাস্থিত বাংলাদেশ মিশনে এই প্রথম বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠিত হলো। এর আগে বঙ্গবন্ধু কর্ণার, বঙ্গবন্ধু মঞ্চ ও মিশনের বাইরের দেওয়ালে ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ নামে একটি ম্যুরাল গত বছর উন্মোচন করেছিলেন উপ-হাইকমিশনার তৌফিক হাসান। মিশণ প্রাঙ্গণের সেখানেই বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়ে থাকে। আবক্ষ ভাস্কর্যটি সম্পূর্ণ ব্রোঞ্জ দ্বারা নির্মিত। দীর্ঘ ছয়মাস সময় নিয়ে তৈরি করেছেন নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের শিল্পী সুবীর পাল।