‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি’ ১৯৫২ সালের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা শহরের একদল দামাল ছেলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে বর্বর পাকিস্তানি পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন। রক্তে ভেসে গিয়েছিল ঢাকার রাজপথ। সেইদিন স্মরণে ১৯৯৯ সালের ৭ নভেম্বর জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সারা পৃথিবীর মানুষ এই দিনটিকে 'ভাষা দিবস' হিসেবে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।
সেদিনের সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের যে বীর শহিদেরা মাতৃভাষার সম্মানার্থে প্রাণ দিয়েছিলেরন, তাদের মধ্যে ছিলেন রফিক, জব্বার , শফিউর, সালাম, বরকতের মতোন যুবক। তাদের মধ্যে শফিউর রহমান ছিলেন ওপার বাংলার মানুষ। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কোন্নগরের কাছে জিটি রোডের ওপর এখনো তাদের বাড়িটি শহিদের জন্মভূমি হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে অত্যন্ত অবহেলায় ও অনাদরে!
অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয় একজন ভাষাশহিদের জন্মভিটা আজ ধ্বংসের মুখে। ১৯১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি এই মহান ভাষাশহিদের জন্ম হয় কোন্নগরে। শফিউর রহমানের বাবা ছিলেন ঢাকার পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ অফিসের সুপারিনটেনডেন্ট। কোন্নগর হাইস্কুলে পড়া শেষ করে কলকাতা গভর্মেন্ট কমার্শিয়াল কলেজ থেকে আইএসসি পাস করার পর ১৯৪৮ সালের শফিউররা সপরিবারে ঢাকায় চলে যান। ঢাকা হাইকোর্টে কেরানির পদে কর্মরত ছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশে অন্যান্যদের সঙ্গে সামিল হয়েছিলেন শফিউরও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪৪ ধারা অমান্য করে রফিক, জব্বার,সালাম, বরকত, শফিউরসহ হাজারও ভাষাপ্রেমী মানুষ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। সেদিনের সেই বিক্ষোভ সমাবেশে ঢাকা শহরের মানুষ শামিল হয়েছিলেন। ক্ষিপ্ত পাকিস্তানি পুলিশ সেই বিক্ষোভকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে দামাল ছেলেদের দেহ মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল। সেদিন প্রভাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা রক্তের নদীতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু তাতেও দমেনি বিক্ষোভ সংগ্রাম। তাদের সেই মরণপণ সংগ্রাম আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছিল। অবশেষে, ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তারপর থেকেই এপার ওপার দুই বাংলা মিলিয়ে এই দিনটি শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে আসছে। কিন্তু সব থেকে বড় আক্ষেপের বিষয়, সেদিনের সেই মরণপণ সংগ্রামের অন্যতম যোদ্ধা শফিউর রহমান যার জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে, তাঁর সেই জন্মভিটাটি আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে অত্যন্ত অনাদর ও অবহেলায়।
সম্প্রতি, যখন পশ্চিমবঙ্গের বড় বড় দেশপ্রেমী মনীষীদের স্মরণে রাখতে তাঁদের জন্মভূমি এবং কর্মক্ষেত্রগুলি সরকার স্বীকৃতি দিয়ে তীর্থস্থানে পরিণত করেছে, কিন্তু সেই ১৯৫২ সালে ঢাকার মাটিতে শহিদ হওয়া সফিউর রহমানের কথা আজ আর কেউ আর মনে রাখেননি। যে বিদ্যালয়ে শফিউর পড়াশোনা করেছেন, পৌরসভার পক্ষ থেকে সেই কোন্নগর হাইস্কুলের একপাশে জিটি রোডের ধারে ছোট্ট একটি শহিদ বেদি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। সেখানেই প্রতিবছর গুটিকয়েক মানুষ যারা শফিউর রহমানকে চেনেন, ভাষা আন্দোলনের বীরগাথার কথা জানেন, তারা ’২১-এর সকালে কয়েক মুঠো ফুল দিয়ে শহিদবেদিতে তর্পণ করেন।
কোন্নগরবাসীর অত্যন্ত আক্ষেপ, এই শহরে এত বড় একজন ভাষা শহিদ জন্ম নিয়েছিলেন, শিক্ষার প্রথম পাঠ হিসেবে এখানকার কোন্নগর হাইস্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন, তাঁর কথা আজ আর কেউই মনে রাখেননি। স্থানীয়দের দাবি, শফিউরের বাড়িটি অন্তত সংরক্ষণ করা হোক অথবা তাঁর স্মরণে এই শহরে যদি একটি মিনার তৈরি করা হয়, তাহলে ভৌগলিক সীমানা অতিক্রম করে আপামর বাঙালি সেই গৌরবের অংশীদার হতে পারবেন। সেইসঙ্গে অমরত্ব পাবে ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসও!