বাঙালির রসনা তৃপ্তিতে নলেন গুড়ের স্বাদ জুড়ি মেলা ভার। শীতের মৌসুমে খেজুরের গুড়ের ঘ্রাণ পেতে বছরভর অপেক্ষা করেন বঙ্গবাসী। দিনে দুপুরে শালমুড়ি দিয়ে নলেন গুড়ের পিঠে পুলি, পায়েসসহ গুড়ের তৈরি নানা আয়োজন খাদ্যরসিক বাঙালি চেখে দেখবে না তা হতেই পারে না!
তবে অসাধ্য হয়ে পড়েছে নির্ভেজাল গুড় পাওয়া। আর কজনই বা চেনে খাঁটি গুড়! ফলে বাজারে কাগজে মোড়ানো গুড়ের পাটালি হোক বা হাঁড়ি ভর্তি তরল নলেন গুড় হোক, এর বেশির ভাগটাই ভেজাল। এসব গুড় তৈরি হচ্ছে চিনি ও আটা দিয়ে আর মেশানো হচ্ছে সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইডের মতো রাসায়নিক।
কয়েক বছর আগেও রাজ্যের বসিরহাট, হাসনাবাদ, বনগাঁসহ ইত্যাদি অঞ্চলে যেসব খেজুর গাছ ছিল, আধুনিকীকরণের পথে বাধা হওয়ায় সেসব বিলুপ্ত হওয়ার পথে। অবশ্য এসব জেলায় এখন যেসব খেজুর গাছগুলোর অস্তিত্ব রয়ে গেছে, আজও শীত এলেই গাছিরা হাঁড়ি নিয়ে বের হন রস সংগ্রহে। কিন্তু আবহাওয়ার পরিবর্তনে সেসব গাছ থেকে আগের মতো রস সংগ্রহ করা যায় না।
তাই একদিকে যেমন রসের পরিমাণ কমছে, অন্যদিকে চাহিদা বাড়ছে নলেন গুড়ের। ফলে রাজ্যে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে ভেজাল গুড় তৈরির কারাখানা। আর তাই দিয়ে কলকাতা ও শহরতলীতে রমরমা ভেজাল গুড়ের ব্যবসা।
কীভাবে তৈরি হয় ভেজাল গুড়? পানিতে ফোটানো হচ্ছে চিনি। সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে চুন, ফিটকারি, ভুসি আটা, খাবার সোডা, কৃত্রিম গন্ধ এবং দেওয়া হচ্ছে সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইডের মতো ক্ষতিকারক রাসায়নিক। সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড মূলত কাগজ ও চামড়া শিল্পে ব্যবহার হয়। গরম অবস্থায় মিশ্রনে ওই রাসায়নিক মেশালেই ভেজাল গুড় খাঁটি খেজুর গুড়ের রং ধরে আর থাকেও দীর্ঘদিন।
কলকাতা মেডিকেল কলেজের নামকরা কেমিস্ট অশোকেশ জানান, মানব শরীরে প্রতিটি রাসায়নিকের ক্ষতিকর দিক রয়েছে। সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড বেশিমাত্রায় পেটে গেলে অ্যাসিডিটিসহ পেটে নানান জটিল রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
গুড় প্রস্তুতকারক সজীব মোল্লা বলেন, সারা বছর আমরা এই মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে খেজুর গাছ কমছে। আর যা আছে তার থেকে আগের মতো রস পাওয়া যাচ্ছে না। এক কেজি খাঁটি নলেন গুড় তৈরি করতে কমপক্ষে ১০ লিটার খেজুর রসের প্রয়োজন। এখন চার-পাঁচটা গাছ মিলিয়ে ওই পরিমাণ রস সংগ্রহ হচ্ছে। এরপর গুড় তৈরির জন্য জ্বালানিসহ মজুরি যোগ করলে ৩০০ থেকে ৩৫০ রুপির নিচে খাঁটি নলেন গুড় বিক্রি করা সম্ভব নয়।
কিন্তু, কে কিনবে এই দামে। তাই বাজারের চাহিদা মেনে আমরা গুড় বানাই। বাজারে কেজি প্রতি ১০০ থেকে ২০০ রুপি দরে গুড় বিক্রি হচ্ছে। দাম যত কম, ভেজাল তত বেশি। গুড় ব্যবসায়ী আতিক বলেন, ‘১০০ রুপি কেজি দরে কেনা গুড় কয়েক হাত ঘুরে কলকাতায় ঢোকে। এরপর ওই গুড় ১৪০ থেকে ১৫০ রুপি দরে বিক্রি হয়। তবে স্পেশাল অর্ডার দিলে কেউ খাঁটি গুড় বানিয়ে দিই। তবে তখন সেই গুড়ের দাম ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ রুপি কেজির নিচে বিক্রি করা যায় না।’