মকবুল আলম (৫৮) একজন কৃষক। তিনি বসবাস করেন চারদিকে নদী বেষ্টিত একটি চরে। তবে তিনি একা নন, এখানে প্রায় দেড় লাখ মানুষের বসবাস। এদের অধিকাংশেরই পেশা কৃষি ও জেলে। বিপুল এই জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা বরাবরই রয়ে গেছে উপেক্ষিত। সরকার থেকে এই সমস্যা উত্তরণে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও স্থানীয়দের সহযোগিতা নেয়ার পরেও কাঙ্ক্ষিত সমাধান পাননি এই জনপদের বাসিন্দারা। মূলত স্বাস্থ্য সহকারীদের ইচ্ছেমতো চলছে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো।
নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার পশ্চিমে অবস্থিত এই চরে রয়েছে ২টি ইউনিয়ন বক্তাবলী ও আলীরটেক। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে মুন্সিগঞ্জ জেলার বালুচর ইউনিয়ন। নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ জেলা শহরের কাছাকাছি এলাকা হওয়া সত্ত্বেও বরাবরই স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত থাকার অভিযোগ তোলেন স্থানীয়রা।
বিশেষ করে বক্তাবলী ও আলীরটেক ইউনিয়নের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কমিউনিটি ক্লিনিক, পরিবার পরিকল্পনা কল্যাণ কেন্দ্র, হাসপাতাল ইত্যাদি স্থাপন করা হলেও তার কোনটিতেই পর্যাপ্ত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ সেবাগ্রহীতাদের। অথচ এসব স্বাস্থ্য সেবা পেতে স্থানীয় বাসিন্দারাই তাদের জায়গা জমি দান করে এসেছেন অকাতরে।
মকবুল আলম বলেন, ‘আমাগো যেই আয় রোজগার তাতে শহরে গিয়া ডাক্তার দেখাইয়া পোষায় না। ক্লিনিক থেকে ৫-১০ টাকার ওষুধ দিয়াই আমাগো চিকিৎসা চলে। বেশি কষ্ট অইলে ধার দেনা কইরা ডাক্তার দেখাইতে হয়। কিন্তু এই ক্লিনিকেও ঠিকমতো ওষুধ দেয় না। মন চাইলে ডাক্তার (ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী) আহে, মন চাইলে আহে না। এমনেই চলে আমাগো অসুখ বিসুখের চিকিৎসা।’
জানা যায়, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে বর্তমান সরকার সারাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করে। প্রতিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পাবেন অন্তত ছয় হাজার মানুষ। ক্লিনিকে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, টিকাদান কর্মসূচি, পরামর্শসহ বিভিন্ন সেবা প্রদান করার কথা ছিল। কিন্তু অদক্ষ জনবলের হাতে দায়িত্ব অর্পণ ও নিয়মিত তদারকির অভাবে এর মূল উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না।
সরেজমিনে নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার আলীরটেক ও বক্তাবলী ইউনিয়নের কয়েকটি কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্লিনিকগুলো দুপুর ১২টার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। অথচ এসব ক্লিনিক সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকার কথা রয়েছে।
বুধবার (২৬ আগস্ট) সরেজমিনে গিয়ে বক্তাবলীর ৩ নং ওয়ার্ডের লালমিয়ার চরে অবস্থিত চর বয়রাগাদী কমিউনিটি ক্লিনিকটি বন্ধ পাওয়া যায়। সরকারি ছুটি না থাকা সত্ত্বেও এদিন ক্লিনিক খুলেননি কর্তব্যরত চিকিৎসক। ধুলোয় ধূসরিত টেবিলে পড়ে রয়েছে একটি সিরিঞ্জের খালি প্যাকেট। যেন কতদিন খোলা হয়নি ক্লিনিকটি। অথচ নিয়মিত সেবা পাবেন এই আশ্বাসে জমিটি দান করেছিলেন স্থানীয় হাজী কালাই চান, আলী আজগর ও সুলতান আহমেদ। যাদের নাম এখনো জমিদাতা ফলকে উল্লেখিত রয়েছে।
একই অবস্থা ইউনিয়নের চরপ্রসন্ন নগর কমিউনিটি ক্লিনিকেরও। বুধবার দুপুর ১২টার দিকে গিয়ে ক্লিনিকটি তালাবদ্ধ অবস্থা পাওয়া যায়। এই ক্লিনিক স্থাপনে জমি দিয়েছেন স্থানীয় জাকির হোসেন। ক্লিনিকটির ভেতরে তাকাতেই চোখে পড়ে মোটা হরফে লেখা- লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা নিন, দুই দিনের বেশি ওষুধ দেয়া হয় না, ওষুধ থাকা সাপেক্ষে সবাই ওষুধ পাবে। আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ! এখানে চিকিৎসা সেবা দেন ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী চিকিৎসক এম. আওলাদ হোসেন শান্ত। এখানে কর্তৃপক্ষ বলতে তিনিই সর্বেসর্বা। কিন্তু লেখাটির বিষয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন ওষুধের মহা সংকট চলছে কমিউনিটি ক্লিনিকে।
নাম গোপন রাখার শর্তে এক কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শক জানান, যে পরিমাণ ওষুধ সরকারিভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়, প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে তা ২ বছর টানা ৪০ জনের মাঝে বিতরণ করলেও শেষ হবে না। এছাড়া এই প্রকল্পটিতে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এখানকার কর্মকর্তাদের বেতন কখনো বিলম্বে বা আটকে থাকে না। সুযোগ সুবিধার দিক থেকেও তারা সবচেয়ে উপরে।
ক্লিনিকের আশপাশের বাসিন্দারা অভিযোগ করে জানান, ডাক্তার ঠিকমতো ওষুধ দেয় না। নিয়মিত ক্লিনিকে আসে না। বেলা ১১টায় আসলেও দুপুর ১২টার আগেই চলে যায়। অসুস্থ নারীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে।
এদিকে ইউনিয়নের গোপাল নগর এলাকায় অবস্থিত কমিউনিটি ক্লিনিকটি বন্ধ পাওয়া যায় দুপুর সাড়ে ১২টায়। স্থানীয়রা জানান, কিছুদিন সংস্কার কাজের জন্য এখানে বন্ধ ছিল চিকিৎসা সেবা। এখন করোনার দোহাই দিয়ে ক্লিনিক খুলেন না স্বাস্থ্য সহকারী।
এ ব্যাপারে কথা হয় চরপ্রসন্ন নগর ক্লিনিকের স্বাস্থ্য সহকারী আওলাদ হোসেন শান্ত’র সঙ্গে। তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে ৩টা পর্যন্ত থাকি। আমি মাঝে বেতন আনতে যাই, ওষুধ আনতে যাই সেজন্য বন্ধ থাকতে পারে। তাছাড়া আমার একার সব কাজ করতে হয়। এসব কারণে একটু সমস্যা হতে পারে।’
একই বিষয়ে মোবাইলে বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করা হয় গোপাল নগর কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্য সহকারী মোহসেনা আক্তারের সরকারি নাম্বারে। কিন্তু তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
বন্ধ থাকা ক্লিনিকগুলোর বিষয়ে কথা হয় উপজেলা স্বাস্থ্য অফিসার ডা. জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়মিত ক্লিনিকগুলো তদারকি করার চেষ্টা করি। কিছুদিন আগে ক্লিনিক বন্ধ পাওয়ায় আমরা গোপাল নগর ও মধ্যনগর ক্লিনিকের কর্তব্যরত সহকারীকে শোকজ করেছি। প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা অব্যাহত রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা আমরা চালিয়ে যাব।’