রাজস্ব বাড়াতে হোল্ডিং ট্যাক্স মূল্যায়ন শুরু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এ যেন শুঁটকির বাজারে বিড়াল চকিদার অবস্থা। যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ট্যাক্স মূল্যায়নের, তারা যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে গেছেন। এমনিতেই নাচুনি বুড়ি, তার ওপরে ঢোলের বাড়ি অবস্থা। যেন টাকা ছাড়া নড়েন না ডিএনসিসির কর কর্মকর্তারা। কথাগুলো একজন ভুক্তভোগীর।
ওই ভুক্তভোগীর খিলগাঁও তালতলা এলাকার ১৩৯৮ হোল্ডিং এর শান্তি নীড় বিল্ডিংয়ে ৩২টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ বিল্ডিংয়ের ৩৫১/বি ফ্ল্যাটে থাকেন আশরাফ আলী। ফ্ল্যাটটি তার নিজের।
সিটি করপোরেশনের আইন অনুযায়ী প্রত্যেক ফ্ল্যাট মালিককে হোল্ডিং ট্যাক্স মূল্যায়নের জন্য তাদের নোটিশ দেয়া হয়। নোটিশ পেয়ে ট্যাক্স মূল্যায়নের জন্য যাবতীয় কাগজপত্র নিয়ে হাজির হন আশরাফ আলী। ডিএনসিসির অঞ্চল-৩ এর অফিসে গেলে কাগজ মিসিং দেখিয়ে তাকে তিনদিন ঘোরানো হয়। একজন সিনিয়র নাগরিক হওয়ায় অন্য উপায় খুঁজতে চাননি তিনি। তাই নিজেই বার বার ডিএনসিসির অঞ্চল-৩ এর অফিসে গিয়েছেন।
কিন্তু উপায় না দেখে তার প্রতিবেশী মোবাশ্বের হাসানের কাছে ট্যাক্স মূল্যায়নের পদ্ধতি জানতে চান তিনি। এরপর প্রতিবেশী মোবাশ্বের হাসান জানান, এখানে যতগুলো ফ্ল্যাট আছে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১৫ হাজার করে টাকা নিয়েছেন উপ কর কর্মকর্তা গাজী মো. ফারুক (জিএম ফারুক)। কেন টাকা নিয়েছেন? উত্তর নেই, নেই কোনো রশীদ।
এ বিষয়ে আশরাফ আলী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ট্যাক্স বসাতে প্রত্যেক ফ্ল্যাট থেকে ১৫ হাজার করে টাকা নিয়েছেন জিএম ফারুক। আমি আমার প্রতিবেশী মোবাশ্বের হাসান সাহেবের ফ্ল্যাটের কাগজপত্র নিয়ে যাই, তিনি আমার কাছে ১৫ হাজার টাকা দেন। আমি সেখান থেকে ১০ হাজার টাকা জিএম ফারুকের হাতে দিয়ে আসি। ঈদের পর ফারুক আমাকে ফোন করে বলেন আশরাফ ভাই একটার টাকা দিলেন, আর একটা তো দিলেন না। তখন আশরাফ আলী জানান, আমি ঘুষ দেব না। তখন আশরাফ আলীকে জিএম ফারুক শোনান এই টাকা শুধু আমি খাই না। আমার উপরে যারা আছেন প্রত্যেককে ভাগ দিতে হয়।’
তার কথার সূত্র ধরে জিএম ফারুকের সঙ্গে কথা হয় বার্তা২৪.কমের এই প্রতিবেদকের। জিএম ফারুক বলেন, ‘না না এরকম তো হয় না। রিসিট দেব না, টাকা নেব, এটা হতে পারে না। এটা সঠিক না। টাকা দেবে কেন? আমরা যখন ট্যাক্স ধার্য করব, ট্যাক্স দিয়ে দেবে। যেটার ট্যাক্স দেবে, সেটার রিসিট দেব। ওনাকে নিয়ে আসেন। আর আশরাফ আলী নামে কাউকে তো চিনি না। এভাবে তো কারো কাছ থেকে টাকা নেয়া হয় নাই। আমরা তো মানুষের কাজ করে দেই।’
এ সময় তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, টাকা কি আমার কাছে দিয়ে গেছে? বললাম হ্যাঁ। আপনার সহযোগী আনিস নামে কাউকে দিয়ে টাকা তুলেন? জবাবে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে তো অনেকে কাজ করে। যদি এ রকম কিছু হয় বসতে অসুবিধা নাই। কত মানুষের কাজ করে দেই, নিয়ে আসুন, বসে সমাধান করে দেব।’
এর আগে সাংবাদিক পরিচয় না দিয়ে ট্যাক্স অ্যাসেসমেন্ট করার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিবেদককে জিএম ফারুক বলেন, ‘ফোনে বলা যাবে না। আসুন একটা সিস্টেম করে দেব।’ কি সিস্টেম? এর জন্য টাকা লাগবে কিনা জানতে চাইলে বলেন, ‘দেখা করলে সব বুঝিয়ে দেব।’
প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আবদুল হামিদ মিয়া বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘হোল্ডিং ট্যাক্সের নিয়ম হচ্ছে বাৎসরিক যত ভাড়া, সেই ভাড়ার ১২ শতাংশ। যদি কেউ লোন নেন, তিনি লোন বেনিফিট পান। তবে লোন হতে হবে ওই ভবন তৈরি অথবা ক্রয়ের জন্য এবং রেজিস্ট্রারি থাকতে হবে। যার নামে বাড়ি, তার নামে লোন থাকতে হবে। এক্ষেত্রে লোনের সুদ যেটা, সেটা মওকুফ হয়, তখন আমরা ট্যাক্স পাই না, নামে মাত্র অল্প টাকা পেয়ে থাকি, ৫০০, ৬০০ টাকার মতো।’
ট্যাক্স মূল্যায়নের জন্য বাড়তি ফি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, এ রকম কোনো সুযোগ নেই। সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মকর্তা নিয়ে থাকলে যথাযথ শাস্তির বিধান করা যাবে। অভিযোগ পেলে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা আমাকে নোট দিলে, আর সত্যতা থাকলে, তদন্ত করে ওই অফিসারকে বরখাস্ত করা হবে।’
অঞ্চল-৩ এর কর কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) রাজস্ব বিভাগ মো. তছলিম উদ্দিন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘হ্যাঁ, জিএম ফারুক নামে আমাদের একজন উপ কর কর্মকর্তা আছেন। ট্যাক্স অ্যাসেসমেন্টের জন্য জিএম ফারুক ফ্ল্যাট প্রতি ১৫ হাজার টাকা নিয়েছেন, রশীদ ছাড়া এটা আসলে কিসের টাকা নিলেন? বিষয়টি আমার নলেজে থাকল, আমি কালকে তাকে জিজ্ঞাসা করব। বিষয়টি আমি দেখব, প্রয়োজনে অ্যাকশনে যাব, ব্যবস্থা নেব।’
এই টাকার ভাগ আপনারাও নাকি পান এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘বুঝতে পেরেছি। এ রকম অনেকের নামই বিক্রি করে টাকার লেনদেন হয়। আমি বিষয়টি দেখব।’
অঞ্চল-৩ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল বাকী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ট্যাক্স অ্যাসেসমেন্টের জন্য কোনো ফি নেই। মানুষ টাকা দেবে কেন? এ রকম কিছু হয়ে থাকলে ওই কর্মকর্তার শাস্তি হবে। যদি এ রকম হয়, তাহলে আমাদের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অভিযোগ ছাড়া তো কিছু করতে পারি না। আপনার (প্রতিবেদকের) কথা অনুযায়ী, একজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে, নিশ্চই ঘটনা সত্য। এখন ওই উপ কর কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলে অস্বীকার করবে। এজন্য লিখিত অভিযোগ করলে ভালো হয়। আসলে এরা (জিএম ফারুকরা) সহজ জিনিসটা এমনভাবে ব্যাখা করে, যেন সবাই একটু ভয় পায়। তখন সাধারণ মানুষ ভোগান্তির ভয়ে টাকা দিয়ে দেয়। ওরা (জিএম ফারুকরা) বলবে আমাকেও টাকা দিতে হয়, সেটাই বলে সব সময়। এরকম প্র্যাকটিস হয়তো ওখানে ছিল। এটা এক ধরনের ব্যবসায় পরণিত হয়েছে। এজন্য আমরা সব কার্যক্রম অনলাইনে করতে যাচ্ছি।’