সিলেটে গণধর্ষণ ও নাগরিক নিরাপত্তা

, জাতীয়

খালেদ উদ-দীন | 2023-08-31 01:47:34

সিলেটে যেখানে গৃহবধূকে গণধর্ষণ করা হয়েছে, সে জায়গাটি আমার বাড়ি থেকে সন্নিকটে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অপরাধের বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। শুধু আমাদেরই নয়, সমগ্র সিলেট তথা দেশবাসীই এই জঘন্যতম নারী নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন।

অথচ ঐতিহ্যবাহী সিলেট পূণ্যভূমি বা আধ্যাত্মিক শহর বলে পরিচিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ এই অঞ্চল ছোটো ছোটো টিলা বেষ্টিত চা বাগান ও পীর আউলিয়ার মাজরের জন্য বিখ্যাত। এই জনপদের মানুষের আত্মীয়তা ও সহাবস্থান গৌরবের বিষয়। কিন্তু গত ২৫ সেপ্টেম্বরে গণধর্ষণ জনমনে আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠেছে। শুক্রবার রাতে নগরীর টিলাগড় এলাকায় এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের একটি কক্ষের সামনে তরুণীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এক তরুণী স্বামীর সঙ্গে নিজেদের গাড়িতে করে শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে এমসি কলেজ এলাকায় বেড়াতে যান। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন তার স্বামী। সন্ধ্যার পর কলেজের প্রধান ফটকের সামনে গাড়িটি রেখে একটি দোকান থেকে তারা কেনাকাটা করেন। পরে ফিরে গাড়িতে বসে গল্প করছিলেন তারা। রাত ৮টার দিকে পাঁচজন যুবক তাদের গাড়িটি ঘিরে ধরে স্বামী ও স্ত্রীকে জোর করে গাড়ি থেকে নামান। তিনজন যুবক তরুণীকে টেনে ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের একটি কক্ষের সামনে নিয়ে যান। স্বামীকে তখন গাড়িতে আটকে রেখেছিলেন দুজন যুবক। ঘণ্টাখানেক পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হলে তিনি এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের একটি কক্ষের সামনে গিয়ে স্ত্রীকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখতে পান।

বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যাচ্ছে এর সঙ্গে কলেজের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্ররাও জড়িত এবং জানা যাচ্ছে এরা ছাত্রলীগের কর্মীও। অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনা সামগ্রিক বিচার বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কারণ এই গণধর্ষণসহ সামাজিক অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় নাগরিক নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে সিলেট জেলা ও মহানগর এলাকায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭৬টি! এর মধ্যে জেলা পুলিশের আওতাধীন ১৩টি থানায় ৫০টি এবং মহানগর পুলিশের আওতাধীন ৬টি থানায় ২৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। করোনাকালের বিভীষিকার মধ্যেও এহেন নারকীয় অপরাধ সবাইকে চিন্তিত করেছে।

সিলেট জেলা পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথম মাস তথা জানুয়ারিতে ৪ জন নারী ও ৬ শিশু ধর্ষিত হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৪টি। এর মধ্যে ধর্ষিতার তালিকায় রয়েছে ৭ শিশু। এ বছর এখনও পর্যন্ত সিলেট জেলায় সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মার্চ মাসে। এ মাসে ৯ জন নারী আর ১০ শিশু লাম্পট্যের কবলে পড়েন।

সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে এসএমপির ৬টি থানা এলাকায় ২৬টি ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে ২১টি ধর্ষণের ঘটনাই জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটেছে। এরপর এ ধরনের ঘটনা কমে আসে। মার্চে ৪টি ও এপ্রিলে ১টি ধর্ষণের ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে পুলিশের খাতায়। আমরা যখন এসব অপরাধ প্রসঙ্গে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলি, তখন তারা অবশ্য একই কথা বলেন। আর তা হলো, ‘যতোগুলো ঘটনা ঘটে, পুলিশ প্রত্যেকটি ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মামলা হয়েছে, অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

কিন্তু বাস্তবে নগরের অপরাধ প্রবণতা কমার আলামত দেখা যায় না। আর অপরাধীরাও থেমে নেই। তাদের চলাফেরা ও কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় না পুলিশের তৎপরতা বা সামাজিক প্রতিরোধের কোনও সুফল পাওয়া যাচ্ছে। করোনার কারণে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ হলেও বেরিয়ে পড়েছে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। এমন অবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তায় অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

আরেকটি সমস্যা হলো, সিলেটের বিনোদন কেন্দ্রের অপ্রতুলতা। সিলেট শহরে বা আশপাশে বেড়ানোর স্থান নেই বললেই চলে। বিকেল হলেই মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে পরে। ফলে দেখা যায়, নির্দিষ্ট কিছু স্থানে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। সম্প্রতি বাইশটিলা, গোয়াবাড়ি ওয়াকিং ব্রিজ এমনকি ক্রিন ব্রিজের পাশেও যে হারে মানুষ যাচ্ছে তাতে সহজেই বুঝা যায় একটি বিভাগীয় শহরের অপর্যাপ্ত বিনোদন কেন্দ্রের সংকটের চিত্র।

১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এমসি কলেজ বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নগরের টিলাগড় এলাকায় ৬০০ শতক জায়গার ওপর ১৯২০ সালে ব্রিটিশ আমলে আসাম ঘরানার স্থাপত্যরীতির ছাত্রাবাস ও আশপাশের পরিবেশ বেশ মনোরম। কলেজ ক্যাম্পাসে সারাদিনই দর্শনার্থীদের আনাগোনা থাকে। বিকেল হলেই স্থানীয় লোকজন এবং শহরের অনেকেই এখানে হাঁটতে আসেন। এমন স্থানে বহিরাগত বখাটেদের কঠোরভাবে দমন করে রাখতে হয়। কিন্তু সেটা করা হয়নি। ফলে ভয়াবহ গণধর্ষণের ঘটনা ঘটলো।

পরিকল্পিত নগর পরিকল্পনা নিয়ে অবকাঠামোর পাশাপাশি বিনোদন বা অবসর যাপন কেন্দ্র স্থাপন করা এখন সময়ের দাবি। সিলেটে সাধারণ নাগরিকের অবাধ চলাফেরা করার যে পরিবেশ দীর্ঘদিন থেকে বিদ্যমান তা কোনও ভাবে নষ্ট হোক, এটা কখনও কাম্য নয়। অথচ সেটা ক্রমশ বিনষ্ট হচ্ছে। এর জন্য বারবার প্রশ্ন ওঠেছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয়ের। সবাই কিন্তু বিশ্বাস করি অপরাধীর কোনো দল থাকতে পারে না। তাকে আইনের হাতে তুলে দিতে হবে। প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। সিলেট জনপদের ঐতিহ্য ও সুনাম এভাবে দেশের কাছে কলঙ্কিত হোক তা কারও কাম্য হতে পারে না।

লেখক অধ্যাপক ও সাহিত্যিক

এ সম্পর্কিত আরও খবর