বাংলা চলচ্চিত্রের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক ভিটা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে সংরক্ষণের উপযুক্ত নয় বলে জানিয়েছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর। অধিদফতরের মহাপরিচালকের নির্দেশে সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
তবে ওই প্রতিবেদনে ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক ভিটা রাজশাহী জেলা প্রশাসন স্থানীয়ভাবে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে সংরক্ষণ করতে পারে বলে মতামত দেওয়া হয়।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়- ‘ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃপক্ষ সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত নয় বলে মত দিয়েছেন। তবে এটি রাজশাহী জেলা প্রশাসক বা রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (আরডিএ) স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণের জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে।’
তবে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়িটি পরিদর্শন করে সংরক্ষণ করা হবে বলে স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীদের প্রতিশ্রুতি দেন। সেসময় প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘ঋত্বিক ঘটকের এই বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বাড়িটির যতটুকু জায়গা আছে, সেটুকু কীভাবে সংরক্ষণ করা যায়; তার ব্যাপারে সরকার অবশ্যই চেষ্টা করবে।’
এদিকে, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সংরক্ষণ করবে না জানিয়ে প্রতিবেদন দেওয়ার পর ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক ভিটা স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে রাজশাহী জেলা প্রশাসন। এ লক্ষ্যে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে কমিটির সদস্যরা ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক ভিটা পরিদর্শন করেছেন। তারা বাড়িটির ভৌত অবকাঠামো পরিমাপ এবং সংরক্ষণ ব্যয় নির্ধারণ করবে এবং দ্রুততম সময়ে পুরো বাড়ির অংশটি কীভাবে সংরক্ষণ করা যেতে পারে তা নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেবে।
জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক হলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. নজরুল ইসলাম। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- কবিকুঞ্জের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন প্রামাণিক, জেলা সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান সরকার, ঐতিহ্যবাহী বড়কুঠি ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবুল হায়াত, রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনারের প্রতিনিধি সহকারী পুলিশ কমিশনার ফারজিনা নাসরিন, গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এমদাদুল হক ও হোমিওপ্যাথিক কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, কমিটি গঠনের পরপরই গত ২৪ সেপ্টেম্বর প্রথম বৈঠক করা হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বুধবার ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি (বর্তমানে হোমিওপ্যাথিক কলেজ) পরিদর্শন করা হয়।
তিনি বলেন, ‘আমরা ঋত্বিক ঘটকের পরিবারের ব্যবহৃত বাড়ির অক্ষত অংশ এবং একটি কুয়া চিহ্নিত করেছি। কমিটির সদস্য সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবুল হায়াত ভবনের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং সামনের জায়গা পরিমাপ করবেন। আর গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এমদাদুল হক ভবনটি যেভাবে রয়েছে, সেভাবে সংরক্ষণের জন্য সম্ভাব্য ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করবেন। আগামী সভায় এ বিষয়ে আলোচনা শেষে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। আশা করছি- সাংস্কৃতিক কর্মীসহ রাজশাহীর মানুষের দাবি অনুযায়ী দ্রুত ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি সংরক্ষণের আওতায় আসবে।’
উল্লেখ্য, চলতি বছরের শুরু দিকে সাইকেল গ্যারেজ তৈরির জন্য ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি ভেঙে ফেলছে রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ—এ খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সম্মিলিত ব্যানারে রাজশাহীতে মানববন্ধনের ডাক দেয় ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটি, রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ এবং বরেন্দ্র ফিল্ম সোসাইটি। প্রতিবাদ লিপি পাঠান ১২ চলচ্চিত্র নির্মাতা। নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুসহ ১১ জন নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি ভেঙে ফেলার প্রতিবাদে বিবৃতি দেন।
প্রসঙ্গত, ঋত্বিক ঘটক জীবনের শুরুর সময়টা কাটিয়েছেন পৈতৃক বাড়ি রাজশাহীতে। এই বাড়িতে থাকার সময় তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়েছেন। রাজশাহী কলেজ ও মিঞাপাড়ার সাধারণ গ্রন্থাগার মাঠে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নাট্যচর্চা করেছেন।
ওই সময় ‘অভিধারা’ নামে সাহিত্যের কাগজ সম্পাদনা করেছেন ঋত্বিক। তাঁকে ঘিরেই তখন রাজশাহীতে সাহিত্য ও নাট্য আন্দোলন বেগবান হয়। এই বাড়িতে থেকেছেন ঋত্বিক ঘটকের ভাইঝি বরেণ্য কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী। এই বাড়ির ৩৪ শতাংশ জমি ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকার রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজকে ইজারা দেয়।