বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য দ্বিতীয় হামলার ভীতিকর ডামাডোলে ১৪২৭ বঙ্গাব্দ তথা ২০২০ সালে চুপি চুপি কার্তিক মাসের সূচনা হলো প্রকৃতিতে বিষন্নতার ঋতু হেমন্তের আবাহনে। হেমন্ত আসে আর যায় নিভৃতিতে। ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ বলে উল্লাস নেই হেমন্তের। আছে বিষন্নতার ছোঁয়া আর একাকীত্বের গুঞ্জরিত ধ্বনি।
বাংলা দিনপঞ্জিতে কার্তিক আর অগ্রহায়ণ দু’টি মাস পেলেও হেমন্ত বড়ই নিশ্চুপ আর সংক্ষিপ্ত ঋতু। শুরুটা মিশে থাকে শরতের উষ্ণ-উজ্জ্বলতায়। শেষটা চলে যায় শীতের শরীরে। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে হেমন্তকে টের পাওয়া যায় খুবই সংক্ষিপ্ততম পরিসরে। মানুষ ও প্রকৃতিকে আলগোছে ছুঁয়ে দিয়ে হেমন্ত আসে, আবার চলেও যায় আসন্ন শীতের অতল ঋতুতে।
বাংলাদেশের পরিবর্তিত ঋতুচক্রে প্রলম্বিত গরম ও বর্ষাই মূলত ছেয়ে থাকে প্রকৃতি ও জীবনের সবটুকু। খানিকটা শীতের পরশ ছাড়া ষড়ঋতুর বৈভব অনুভব করাই যায় না আজকাল। ঋতুগুলো যেন প্রকৃতিতে নয়, অনাদরে মুখ গুজে থাকে ক্যালেন্ডারের ধূসর চিত্রাবলীর একেকটি পাতায়।
হেমন্ত প্রকৃতির মতো সাহিত্যেও অনাদৃত, যদিও বাংলা ভাষার কবি ও সাহিত্যিকরা ঋতু আর প্রকৃতি বন্দনায় সিদ্ধহস্ত। তথাপি হেমন্ত নিয়ে নেই তেমন কোনও কাব্যিক বহিঃপ্রকাশ। ব্যতিক্রম জীবনানন্দ দাশ। তিনি হেমন্তকে নানাভাবে দেখেছেন। ব্যবহার করেছেন তার কবিতায় এমন অনেক শব্দ, যা হেমন্তের সমার্থক।
এজন্যই, একমাত্র জীবনানন্দকেই বলা হয় ‘ধূসর ঋতু হেমন্তের কবি’। তার আরেকটি পরিচিতি হলো ‘নির্জনতম কবি’, তা-ও হেমন্তেরই সমার্থক। হেমন্তকে মনে রেখে তিনি তার কবিতায় বলেছেন, ‘যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে/পথের পাতার মতো তুমিও তখন/আমার বুকের ‘পরে শুয়ে রবে।'
হেমন্ত-গন্ধী কবিতা ও শব্দাবলীতে জীবনানন্দের রচনাসমূহ ঋদ্ধ। তার কবিতায় ‘নবান্ন’, ইদুঁর’, ‘শালিক’, ‘লক্ষ্মীপেঁচা’, ‘নির্জন স্বাক্ষর’, কার্তিকের নীল কুয়াশায়’ ইত্যাদি শব্দ ও উপমা এমন যুৎসইভাবে প্রয়োগ করেছেন যে, তার কবিতা পাঠে হেমন্তের সমগ্র আবহ মানসপটে চলে আসে।
জীবনানন্দ ভারাক্রান্ত আবেগে উচ্চারণ করেছেন, ‘যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়/যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে-ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে/যখন চড়াই পাখি কাঁঠালীচাপাঁর নীড়ে ঠোটঁ আছে গুজে/যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে খয়েরী পাতায়/যখন পুকুরে হাঁস সোঁদা জলে শিশিরের গন্ধ শুধু পায়/শামুক গুগলিগুলো পড়ে আছে শ্যাওলার মলিন সবুজে-।'
হেমন্তকে নিয়ে এতো আবেগ আর মন-খারাপের আবহ জীবনানন্দ ছাড়া অন্য কোনো কবিই উচ্চারণ করেন নি। যে ঋতুর হৈমন্তী সন্ধ্যাগুলো খুব তাড়াতাড়ি চলে যেতে চায় রাতের কোলে, তাকে কবি অক্ষয় করে রেখেছেন। দিন ও রাত্রির প্রহরে প্রহরে যে হেমন্ত এঁকে দিচ্ছে প্রকৃতির নিজস্ব বৈভব ও স্বাতন্ত্র্য, জীবনানন্দ পাঠে সে ঋতু বার বার ফিরে ফিরে আসে।
হেমন্ত আসলেই বেদনামগ্ন-নস্টালজিতায় মাখানো এক রোমান্টিক ঋতু। মখমল মসৃণ হাওয়ার স্নিগ্ধতায় জুড়িয়ে দেয় সকলের বিরহী মন-প্রাণ। প্রকৃতিতে বড় বেশি মায়াবী টান নিয়ে আসে হেমন্ত। গ্রীষ্মের রূঢ়তা নেই, নেই শীতের আড়ষ্ঠতা, মাঝামাঝি এক অনির্বচনী-পুলকিত স্পর্শে মানুষের দেহে ও চৈতন্যে জাগরিত হয় ব্যাখ্যাতীত অনুভূতি।
যান্ত্রিক নগর-জীবনের অন্তঃহীন দুর্ভোগের নৈমিত্তিক অভিজ্ঞতা শেষে ক্ষুদ্র-বদ্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দি প্রাত্যহিকতায় হেমন্তের যথাযথ সুধারস পান করা অসম্ভব। অথচ খোলা আকাশ আর অবারিত প্রকৃতিতে কান পেতে শোনা যায় হেমন্তের পদধ্বনি, দেখা যায় চারপাশে বয়ে চলা রূপ, গন্ধ, রঙ ও রসের মঙ্গলালোক।
চিরায়ত বাংলার কৃষিভিত্তিক জনজীবনে হেমন্ত আনে ফসলের ঘ্রাণে ঘ্রাণে মাতাল আয়োজন, যার মধ্যে অন্যতম নবান্ন, উৎসব, মেলা, পার্বণ। সংস্কৃতির বর্ণময় বিভা আর লোকজ ঐতিহ্যের বহুমাত্রিক প্রভা তীব্রভাবে প্রস্ফুটিত করে হেমন্ত, প্রতিটি ঘরে ঘরে, অন্তরে অন্তরে। বাংলার, বাঙালির প্রিয়তম ঋতু হয়ে হেমন্ত সবাইকে জড়িয়ে রাখে অপার ভালোবাসার মোহময় বন্ধনে।