ভাষা আন্দোলন আর স্বাধীনতার কথা শোনায় তিন নদী পরিষদ

, জাতীয়

আব্দুর রহমান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কুমিল্লা | 2023-08-31 07:56:28

** গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জানতে পারছে নতুন প্রজন্ম

** বিকশতি হচ্ছে সাংস্কৃতিক চর্চাও

মেঘনা, তিতাস ও গোমতী নদী (তিন নদী) পাড়ের সংস্কৃতি চর্চাকে বিকশিত করার উদ্দেশ্যে ১৯৮৩ সালে গঠিত হয়েছিলো একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। নাম দেওয়া হয়েছিলো ‘তিন নদী পরিষদ’। তিলতিল করে তিন নদী পরিষদ এখন কুমিল্লার অন্যতম প্রধান একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে সংগঠনটি। একটা সময় সংগঠনের মঞ্চকে ব্যবহার করে হয়েছে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামও।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৩৮ বছর ধরে কুমিল্লার নগর উদ্যানের জামতলায় নতুন প্রজন্মকে ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার  গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস শুনিয়ে আসছে সংগঠনটি। মহান ২১শে ফেব্রুয়ারি উপলে ১৯৮৪ সালে তিন নদী পরিষদ সর্বপ্রথম ২১ দিনব্যাপী আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলো। সে সময় কুমিল্লা পৌর পার্কের জাম গাছ তলায় অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ওই অনুষ্ঠানটির। বর্তমানে ওই স্থানটিই কুমিল্লা নগর উদ্যানের জামতলা নামে পরিচিত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৮৩ সালে তিন নদী পরিষদ গঠিত হওয়া পর ১৯৮৪ সালে কুমিল্লার তৎকালীন জেলা প্রশাসক  সৈয়দ আমিনুর রহমান পৌরসভার মাধ্যমে একুশ নিয়ে অনুষ্ঠান করার জন্য পৌর পার্কের জাম গাছের নিচে একটি পাকা মঞ্চ করে দেন। এরপর থেকে গত ৩৮ বছর ধরে বহু প্রতিকূলতার মাঝেও ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি উপলে ২১ দিনব্যাপী আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে সংগঠনটি। অমর একুশ নিয়ে ২১ দিনব্যাপী তিননদী পরিষদের এই অনুষ্ঠানমালা বাংলাদেশে একটি ব্যতিক্রমী ও বিরল দৃষ্টান্ত। দেশের অন্য কোথাও এই ধরণের অনুষ্ঠান হয় না বলে জানা গেছে। বিগত দিনে তিন নদী পরিষদের এই মঞ্চে কুমিল্লার ভাষা সৈনিকদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছেন প্রয়াত অ্যাডভোকেট আহমেদ আলী, অধ্যাপিকা লায়লা নূর, আলী তাহের মজুমদার, মো. আবদুল জলিলসহ অসংখ্য গুণীজন।

সংগঠনের সূত্র জানায়, ভাষা আন্দোলন নিয়ে কুমিল্লার রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। কুমিল্লার সন্তান শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উদ্যোক্তা রফিকুল ইসলামসহ অনেক গুণীজন বাংলা ভাষার সম্মানকে তুলে ধরতে কাজ করেছেন। কুমিল্লার অজিত গুহ, মেজর গণিও ভাষার সম্মান রায় ভূমিকা রেখেছেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই পাকিস্তান গণপরিষদে সর্ব প্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। তিন নদী পরিষদ এসব গুণী মানুষের কথা, ভাষা আন্দোলনের কথা ও স্বাধীনতার কথাই নতুন প্রজন্মসহ সকল মানুষকে শোনাচ্ছে গত ৩৮ বছর ধরে।

তিন নদী পরিষদের পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আবুল হাসানাত বাবুল বলেন, ১৯৮৪ সালে মা, মাতৃভূমি ও ভাষার প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা সূচনা করেছিলাম তিন নদী পরিষদের। আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে মা, মাটি, দেশ, বাংলা ভাষা এবং একুশের আবেদনকে পৌঁছে দিতে চাই। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর ২১ দিনব্যাপী ভাষার অনুষ্ঠান করছি। কারও কাছে আমাদের কোন প্রত্যাশা নেই। শুধু একটাই চাওয়া আছে পরের প্রজন্মের কাছে। তারা যেন এই ধারা অব্যাহত রাখে।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জমির উদ্দীন খান জম্পি বলেন, গত ৩৮ বছর ধরে আমরা নতুন প্রজন্মসহ সকলের কাছে স্বাধীনতা, ভাষা আন্দোলন এবং বাংলার ইতিহাসকে ছড়িয়ে দিচ্ছে এই মঞ্চ। স্বৈরাচার এরশাদ যখন সারাদেশে সকল রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ করেছিল, তখন এই তিন নদী পরিষদের মঞ্চ থেকেই কুমিল্লার সকল লোকজন স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়। এরপর থেকে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামও হয়েছে এই মঞ্চ থেকে। কুমিল্লাকে বলা হয় ‘শিক্ষা-সাংস্কৃতির’ রাজধানী। সেই ঐতিহ্য রক্ষায় তিন নদী পরিষদের পথচলা অব্যাহত থাকবে।

কুমিল্লার বিশিষ্ট শিাবিদ অধ্যাপক শান্তি রঞ্জন ভৌমিক বলেন, ভাষা আন্দোলন নিয়ে কুমিল্লার অনেক গৌরবের ইতিহাস রয়েছে। তিন নদী পরিষদ ভাষা আন্দোলনের গৌরবের সেই ইতিহাসগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে গত ৩৮ বছর ধরে পৌঁছে দিচ্ছে। এটা অত্যন্ত প্রশংসনীয় কাজ। প্রতি বছর একুশ এলেই সকলেই ছুটে আসেন এই জামতলায়। এজন্য কাউকে নিমন্ত্রণও করতে হয় না। বাংলাদেশে আর কোথাও এ ধরণের একটি অনুষ্ঠান হয়ে বলে আমার জানা নেই।

তিনি আরও বলেন, কুমিল্লার কৃতি সন্তান শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সর্বপ্রথম পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিলেন। তখন সমস্ত পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। তারা বাংলায় কথা বলতেন। কিন্তু শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সেই দাবি তখন তারা মেনে নেয়নি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রূপকারও আমাদের রফিকুল ইসলাম। এসব কথা সকলের মাছে ছড়িয়ে দিচ্ছে সংগঠনটি। 

এদিকে, গত ১ ফ্রেব্রুয়ারি বিকেলে তিন নদী পরিষদের ২১ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার শুরু হয়েছে। ওইদিন এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর বলেন, কুমিল্লা গৌরবের রাজধানী। ভাষা নিয়ে সর্বাধিক গৌরবের অধিকারী কুমিল্লার সন্তানরা। কুমিল্লার সন্তানদের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে, প্রমিত বাংলা চর্চা করার। প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক আমাদের একটি কার্যক্রম থাকবে শুদ্ধ বাংলা বলা, শুদ্ধ বাংলা লিখা। গত ৩৮ বছর যাবৎ তিন নদী পরিষদের ২১ দিনব্যাপী এ আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানাই। একুশে পদকের জন্য তিন নদী পরিষদকে প্রশাসন সহযোগীতা করবে বলে জানান তিনি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর