সড়ক নিরাপদ রাখতে নিজেরাই অনিরাপদ!

ঢাকা, জাতীয়

শাহরিয়ার হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 18:22:49

প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট যেকোনো দুর্যোগে সড়কে দায়িত্ব পালন করতে হয় ট্রাফিক পুলিশদের। যারা সড়ক নিরাপদ করতে সব সময় কাজ করে চলেছেন, সড়কে তাদের জীবন কতটুকু নিরাপদ? মূলত নিজেদের জীবন ঝুঁকিতে রেখে জনগণের সেবা করে যাচ্ছেন তারা। এমনকি সড়ক দুর্ঘটনায় মারাও যান অনেকে।

ট্রাফিক পুলিশ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩ বছরে শুধু রাজধানীর সড়কে দায়িত্বপালনকালে দুর্ঘটনার শিকার হন ৩২ জন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য। যাদের মধ্যে নিহত হয়েছেন ৫ জন, গুরুতর আহত হয়েছেন ২৫ জন ও সামান্য আহত হয়েছেন ২ জন।

খোঁজ নিয়ে গেছে, যারা গুরুতর আহত হয়েছেন তাদের অনেকে এখনও কাজে ফিরতে পারেননি। যারা ফিরেছেন তারা অনেক কষ্ট সহ্য করে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৭ সালের ৩ নভেম্বর সড়কে কর্তব্যরত অবস্থায় দুর্ঘটনার শিকার হন ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের কনস্টেবল মো. ফিরোজ। দুর্ঘটনায় ডান পায়ের হাঁটু ও গোড়ালী ভেঙে যায় তার। ৭ মাস চিকিৎসার পর সম্প্রতি তিনি আবার কাজে যোগ দিয়েছেন।

নিজের অসুস্থতার বিষয়ে ফিরোজ বার্তা২৪.কম’কে বলেন, ‘ভেঙে যাওয়া পায়ে রড ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে এখন আগের মতো রাস্তায় টানা ৮ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। কয়েকদিন আগে দায়িত্বপালনকালে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তাই এখন জাতীয় সংসদের ডিউটি পেয়েছি। এখন এমনিতে ভালো আছি কিন্তু সারাজীবনের জন্য খোঁড়া হয়ে গেছি।’

২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কর্তব্যরত অবস্থায় দুর্ঘটনার শিকার হন ট্রাফিক বিভাগ, দক্ষিণের নারী পুলিশ সার্জেন্ট ময়না আক্তার। সে সময় তিনি গর্ভবতী ছিলেন। দুর্ঘটনায় তার ডান হাত ভেঙে যায়। কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে সম্প্রতি তিনিও কাজে যোগ দিয়েছেন।

ময়না আক্তার বার্তা২৪.কম’কে বলেন, ‘আমি কাজে যোগ দিয়েছি বেশ কয়েক মাস হলো, নিয়মিত কাজও করছি। তবে আমার বাচ্চাটাকে এখনও ভালোভাবে কোলে নিতে পারি না। কারণ হাতে একটুও প্রেশার বা বাড়তি চাপ সহ্য করতে পারি না।’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের এডমিন ও রিসার্চ উইংয়ের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার গোপাল চন্দ্র পাল বার্তা২৪.কম’কে বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশের ডিউটির কোনো সিডিউল নেই। নামে মাত্র ৮ ঘণ্টা বলা হলেও  অনেক সময় ১০/১২ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়। এছাড়া দায়িত্বপালনকালে সড়কে ট্রাফিকদের খুবই মনযোগী থাকতে হয়। না হলে সাধারণ মানুষ বা ট্রাফিক নিজেই দুর্ঘটনায় পড়তে পারেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘এতো কিছুর পরও সাধারণ মানুষ ট্রাফিক পুলিশকে পছন্দ করে না। জনগণ আইন তো মানেই না, কিছু বলতে গেলে হুমকি-ধামকি দেয়। দায়িত্ব পালনকালে জীবনের ঝুঁকি থাকলেও তাদের বাড়তি কোনো ঝুঁকি ভাতা দেওয়া হয় না। তারা যে কতটা দুর্বিষহ জীবন-যাপন করেন, সেটা পুলিশ ব্যারাকে না গেলে কেউ বুঝতে পারবেন না।’

অন্যদিকে রাজধানীর পান্থপথে ট্রাফিক সিগন্যালে সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল থেকে দায়িত্ব পালন করছেন ট্রাফিক কনস্টেবল মজিবর। দুপুরে ব্যস্ততার ফাঁকে বার্তা২৪.কম’র এই প্রতিবেদকের সঙ্গে তার কথা হয়। ৪২ বছর বয়সী মজিবর বলেন, ‘দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছে জীবন। নানা রোগ-বালাই আর শারীরিক যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। শারীরিক বা মানসিক কোনোভাবেই ভালো নেই আমি।’

তিনি অক্ষেপ করে বলেন, ‘সকালে ডিউটিতে আসার পর একটু ফ্রেশ হওয়ারও সুযোগ পাওয়া যায় না। একটু বসে বিশ্রাম নেওয়ারও কোনো ব্যবস্থা নেই এখানে। এই ভাবেই বেঁচে আছি আমরা।’

এ বিষয়ে মহানগর ট্রাফিক পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মীর রেজাউল ইসলাম বার্তা২৪.কম’কে বলেন, ‘পথচারীরা হরহামেশাই ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করেন। কেউ একবারও ভাবেন না সবার ভালোর জন্যই ট্রাফিক সদস্যরা রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ের মধ্যেও দায়িত্ব পালন করেন। তাদের কাজে সহযোগিতা তো দূরের কথা, উল্টো কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় অনেকে। আইন ভাঙলে মামলা দিতে গেলে নানামুখী তদবির শুরু করেন সবাই। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সড়কে নিরাপত্তা দেন ট্রাফিক পুলিশ। তাদের সম্মান করা উচিৎ সবার।

এ সম্পর্কিত আরও খবর