প্রতি বছর ভাষা দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন হলেও মফস্বলে বাস করা ভাষা সংগ্রামীরা বরাবরের মতোই অবহেলিত। স্থানীয় প্রশাসনও ভাষার মাসে খোঁজ নেয় না তাদের। ফলে যথাযথ সম্মান না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন মাগুরার প্রবীণ ভাষা সংগ্রামী খান জিয়াউল হক। এ সময় তিনি সব ভাষা সংগ্রামীদের রাষ্ট্রীয় সম্মানে সমাহিত করার দাবি জানান।
খান জিয়াউল বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা যুদ্ধের বীজ রোপিত হয়েছিল। কিন্তু ভাষা সংগ্রামীদেরকে সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের উত্তাল দিনগুলোতে ভাষা সংগ্রামীদের বীরত্বপূর্ণ আন্দোলনের কারণেই একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। তবুও ভাষা সংগ্রামীরা আজ চরমভাবে অবহেলিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘মাগুরার ভাষা সংগ্রামীরাও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় অবদান রেখেছিলের। কয়েকজন ভাষা সৈনিক ওই সময় পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেণ। কিন্তু তাদের অনেকেই কোনও স্বীকৃতি না পেয়ে অখ্যাত অবস্থায় মারা গেছেন। ১৯৪৮ সালে যখন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা করা হয় তখন আমি যশোর এমএম কলেজে ছাত্র। এসময় এমএম কলেজর সাধারণ ছাত্ররা প্রতিবাদ মিছিল করে। ৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন তীব্রতর হতে থাকে তখন আমি বিএ’র পরিক্ষার্থী। যশোরে তখন মিছিল মিটিংয়ে অগ্রভাগে থেকে কাজ করেছি।’
এই ভাষা সৈনিক বলেন, ‘যেহেতু আমি মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম তাই আমাকে তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতারা সরাসরি আমাকে ভাষা আন্দোলনের বিষয়ে জানাতেন। যদিও একসময় আমি মুসলিম ছাত্রলীগ ত্যাগ করি। এরপর আমাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে পুলিশ। এক পর্যায়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি আমি বন্ধুদের পরামর্শে মাগুরায় আমার বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হই। মাগুরায় ফিরে আমি ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার কাজ শুরু করেছিলাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদিও প্রাথমিকভাবে তৎকালীন প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাতে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ সারাদেশের মতো মাগুরাতেও ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় ছাত্রনেতারা ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই তৎকালীন ইসলামিক কলেজ যা বর্তমানে মাগুরা সরকারী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ হিসেবে পরিচিত সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে নিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনে অংশ নিয়ে তৎকালীন সময়ে স্কুল বয়সেই অনেকে জেল-জুলুম, নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। এরপর তারা মাগুরার মহকুমার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেন। আমিসহ ছাত্রনেতা নাসিরুল ইসলাম আবু মিয়া, আমিনুল ইসলাম চান্দু মিয়া, জলিল খান এবং আজিম দেওয়ান প্রধানত মহকুমা সদরে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিই।’
আন্দোলনের চরম মুহূর্ত সম্পর্কে তিনি বলেন, ’২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ঘটনা জানতে পেরে আমরা পরদিনই মাগুরার সংগঠক নাসিরুল ইসলাম আবু মিয়ার সাথে দেখা করি। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি মিছিল ও সমাবেশ করা হবে। ২৩ ফেব্রুয়ারি সকালেই সবাই শহরের সেগুনবাগিচায় একত্রিত হই। সেখানে আবু মিয়ার সভাপতিত্বে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ শেষে আমরা মিছিল নিয়ে এগিয়ে চৌরঙ্গী মোড়ে আসতেই পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। অন্যরা নিরাপদ স্থানে সরে গেলেও আমি, জলিল খান এবং চান্দু মিয়া পুলিশের হাতে গ্রেফতার হই। আমাদেরকে পার্শ্ববর্তী জিআরও অফিসে বসিয়ে রাখা হয়। পরে ছাত্রদের বিক্ষোভের চাপে পুলিশ আমাদের ছেড়ে দেয়।’
এছাড়াও সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলের ছাত্রনেতা মীর্জা শওকত মাগুরায় এসে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সভা সমাবেশ করতে থাকেন। এছাড়াও ৫৪’ সালে মাগুরার শ্রীপুর থানার রাইচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র একে হামিদুজ্জামান এহিয়া শ্রীপুর থানার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভাষা আন্দেলনের পক্ষে সংঘটিত করতে থাকেন। ওই সময় হামিদুজ্জামান এহিয়াকে বেলুচ আর্মড ফোর্স গ্রেফতার করে। তার উপর অমানুসিক পুলিশি নির্যাতন চালানো হয় বলে ভাষা সৈনিক খান জিয়াউল হক জানান।
এই ভাষা সৈনিক বলেন, ‘জীবনে যা পেয়েছি তা অনেক। তবে একটাই আক্ষেপ, আজও পর্যন্ত ভাষা সংগ্রামীদের কোনও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের মতো কেন ভাষাসংগ্রামীদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয় না। নতুন প্রজন্মকে ভাষা সৈনিকদের অবদান সম্পর্কে জ্ঞাত করা অত্যন্ত জরুরি ছিল। কারণ এতে করে জাতীয় যে কোনো সংকটে নতুন প্রজন্মও যে কোনও ত্যাগ স্বীকারে উদ্বুদ্ধ হতো।