প্রস্তাবনা নিয়ে বক্তব্যের সুযোগ পেয়েছিলেন মাহবুব তালুকদার!

ঢাকা, জাতীয়

ইসমাঈল হোসাইন রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-23 02:59:07

টানা দুটি কমিশন সভায় ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে আলোচনায় আসেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। এমনকি বাকস্বাধীনতা হরণেরও অভিযোগ করেন তিনি। তবে নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, প্রস্তাবনা নিয়ে তাকে আলোচনার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু প্রস্তাবনা সভার এজেন্ডাভুক্ত না করায় তিনি সভা বর্জন করেন।

প্রসঙ্গত, গত ১৫ অক্টোবর কমিশন সভা শুরুর সাত মিনিটের মাথায় সভা বর্জন করেন মাহবুব তালুকদার। অন্য তিন জন নির্বাচন কমিশনার তার প্রস্তাবিত এজেন্ডা নিয়ে আপত্তি জানালে তা সভার এজেন্ডাভুক্ত হয়নি। ফলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি নিজেও সেদিন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন।

নির্বাচন কমিশনের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, সভার প্রথম দিকে এজেন্ডা নিয়ে আলোচনার শুরুতেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কমিশনকে অবহিত করেন, জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার কিছু প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে চান। কিন্তু অন্য তিন নির্বাচন কমিশনার ওই প্রস্তাবনা সভার এজেন্ডাভুক্ত করার বিষয়ে আপত্তি তুলে ইউও নোট দেন। পরে সিইসি জানান, সভায় এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হোক সেটি তিনি নিজেও চান না। ফলে এ প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব না। তবে এজেন্ডার বাইরের বিবিধতে এসব বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।

এসময় নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, অাপনি চাইলে বিবিধতে প্রস্তাবনাগুলো উপস্থাপন করেন।

জবাবে মাহবুব তালুকদার জানান, তিনি কিছু বলতে চান। তখন সিইসি সংক্ষেপে তাকে কিছু বলার অনুরোধ জানান। এ সময় তিনি অপমাণিত হয়েছেন এবং তার বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন। কিছুক্ষণ পরে নোট আব ডিসেন্ট দিয়ে তিনি সভা বর্জন করেন।

সূ্ত্রটি আরো জানিয়েছে, সভায় মাহবুব তালুকদারকে এজেন্ডার বাইরের বিবিধতে আলোচনার জন্য বলা হয়। ফলে তার বাক স্বাধীনতা হরণের বিষয়টি সত্যি নয়।

জানা গেছে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর মাহবুব তালুকদার 'একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ অংশীদারমূলক ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে কতিপয় প্রস্তাবনা' শিরোনামে তার বক্তব্য নির্বাচন কমিশন সভায় উপস্থাপন করার জন্য সিইসি বরাবর একটি ইউও নোট পাঠান। পরবর্তীতে এর একটি সংশোধনীও প্রেরণ করা হয়। গত ৮ অক্টোবর কমিশন সচিবালয় থেকে ইউও নোটের মাধ্যমে তাকে জানানো হয়, তার প্রস্তাবনাগুলি ১৫ অক্টোবর ৩৬তম কমিশন সভায় উত্থাপন করার জন্য সিইসি তাকে অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু ১১ অক্টোবর তার এই ইউও নোটের প্রেক্ষিতে তিন নির্বাচন কমিশনার একটি ইউও নোট দেন। যেখানে তারা মাহবুব তালুকদারের প্রস্তাবনাগুলো ইসির সভায় উত্থাপনের বিষয়ে আপত্তি জানান।

মাহবুব তালুকদারের প্রস্তাবে বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে একজন নির্বাচন কমিশনার ইউও নোটে লেখেন, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে আইনানুগ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এটা বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। নির্বাচন কমিশনকে বাংলাদেশের সংবিধান এবং বিদ্যমান আইন ও বিধি বিধানের আলোকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। সংবিধান, আইন ও বিধি-বিধানের বাইরে গিয়ে কোনো কার্যক্রম গ্রহণের অবকাশ নেই। প্রস্তাবিত প্রস্তাবনায় যে সকল বিষয় তুল ধরা হয়েছে তার অনেকগুলোই সংবিধান এবং বলবৎ আইন বিধি-বিধদানের পরিপন্থী এবং উপস্থাপিত বক্তব্য অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক তথ্য নির্ভর নয়। তদুপরি প্রস্তাবনায় বহুলাংশে রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠির মতাদর্শের প্রতিফলন ঘটেছে মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। তাই এ ধরনের একটি প্রস্তাবনা কমিশন সভায় আলোচনা করা যথাযথ হবে না।

চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং তার কার্য-পরিধি তফসিল ঘোষণার পূর্বেই নির্ধারণ করার যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা এ পর্যায়ে বিবেচনা করা যথাযথ হবে না। সার্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে তফসিল ঘোষণার পর বিষয়টি বিবেচনা করাই যথাযথ হবে।

এদিকে নোট অব ডিসেন্টের পর মাবুব তালুকদারকে নিয়ে আলোচনায় সরগরম গোটা নির্বাচন কমিশন। অন্যদিকে কমিশনের বাইরে রাজনৈতিক দল থেকে তার পদত্যাগের দাবিও উঠেছে। আজ এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের পদত্যাগ দাবি করেছে ১৪ দল। ক্ষমতাসীন জোটের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘মাহবুব তালুকদার সাংবিধানিক পদে থেকে  অসাংবিধানিক কথা বলায় তার দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়া উচিত।’

তবে এ বিষয়ে অবস্থান জানতে যোগাযোগ করা হলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি মাহবুব তালুকদার।

অন্যদিকে বুধবার নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম সাংবাদিকদের জানান, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকাদারের ৫ দফা প্রস্তাব ইসির সভায় আলোচনা হয়নি। একজন কমিশনার কমিশন সভায় এসব প্রস্তাব দিতে পারেন কি-না সে বিষয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

কবিতা খানম বলেন, আমি পাঁচটি প্রস্তাবই দেখেছি। প্রথমট ছিল নির্বাচনে সেনা বাহিনী রাখা হবে কি-না। কিন্তু এখনো সে বিষয়ে আলোচনার সময় আসেনি। এছাড়া স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে আনার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু এটা সাংবিধানিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যস্ত। সুতরাং এটা নির্বাচন কমিশনের অধীনে আনার কোনো সুযোগ নেই। সংবিধানের ৫৫ এর (২) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে এ বিষয়ে বলা হয়েছে। এটা যদি আলোচনা করি তাহলে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক একটা বিষয় চলে আসে। আমরা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কী নিয়ে সংলাপ করবো? রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ইতোমধ্যে সংলাপ করেছি। যে সময় আছে তার মধ্য সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করা সম্ভব বলে মনে হয় না।

কবিতা খানম বলেন, এই সভায় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয় ছিল না। তাই এখানে নোট অব ডিসেন্ট দেয়ার মতো কিছু নেই। ওনার কিছু প্রস্তাব ছিল। প্রস্তাবের বিষয়ে আলোচনার সুযোগ নেই, কারণ তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে কমিশনের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে বা ঐক্য নষ্ট হয়েছে মনে করার সুযোগ নেই।

তবে এ বিষয়ে অপর দুই নির্বাচন কমিশনার মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এদিকে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ব্যক্তিগত সফরে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন। তফসিল ঘোষণার আগেই তিনি দেশে ফিরবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তবে আগামী ২১ অক্টোবর আরেকটি কমিশন সভা অনুষ্ঠিত হবে। এই সভায় তফসিল ঘোষণার তারিখ চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। সে সময় দেশের বাইরে থাকায় সভায় অংশ নিতে পারবেন না মাহবুব তালুকদার। এছাড়াও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ও দেশের বাইরে থাকবেন তিনি।

এর আগে গত ৩০ আগস্ট জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ (আরপিও) সংশোধন নিয়ে কমিশন সভা চলাকালে বৈঠক বর্জন করেছিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।

এ সম্পর্কিত আরও খবর