দশ বছরের শাবাব সারোয়ার। বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন নিউজের অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর সারওয়ার হোসেন ও ন্যাশনাল আইডিয়াল কলেজের শিক্ষক সানজিদা আরার একমাত্র ছেলে। সোমবার ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে ভর্তি হয় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। চিকিৎসকরা মস্তিষ্কে সংক্রমণ হয়ে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করেন। সেদিনই তাকে শিশু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র-পিআইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। বুধবার (৪ আগস্ট) শাবাবকে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার জীবন রক্ষা করা যায়নি। ওই দিন দিবাগত রাত ১টা ১০ মিনিটে শাবাব চলে যায় না ফেরার দেশে। শাবাব রাজধানীর ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিল।
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে শিশুদের সামনে বিপদ হয়ে আসছে ডেঙ্গু। আক্রান্তের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা বাড়ায় উৎকণ্ঠা বাড়ছে। সম্প্রতি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও চার জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ বছর ডেঙ্গু সন্দেহে মারা যাওয়া ১০ জন রোগীর তথ্য পর্যালোচনার জন্য সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়েছে। তবে গতকাল পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর পর্যালোচনা শেষ হয়নি।
ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, গত কয়েকদিন ধরে এডিস মশাবাহিত এই ভাইরাস জ্বরে যেভাবে আক্রান্ত রোগী বাড়ছে, তাতে অনেক শিশুও পাচ্ছেন তারা। জ্বর, মাথা ব্যথা, চোখে ব্যথা, শরীরে ব্যথা, মুখ থেকে রক্তক্ষরণ, পেট ফুলে যাওয়া, শরীরে পানি আসা, গায়ে র্যাশ ওঠা- এসব লক্ষণ নিয়ে শিশুরা হাসপাতালে আসছে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক শফি আহমেদ জানিয়েছেন, প্রতিদিনই ৯-১০ জন শিশু ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। ডেঙ্গু ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম নিয়ে আসছে। এগুলোতে অবস্থাটা বেশি খারাপ হয়ে যায়। ৪ জন শিশু মারা গেছে। শেষ পর্যায়ে তারা আসছে এবং তাদের কো-মরবিট কনডিশন নিয়ে আসছে। মেনিনজাইটিস, লিউকোমিয়া আক্রান্তরা মারা যাচ্ছে।
শিশুদের জন্য করোনাভাইরাসের চেয়ে ডেঙ্গুকে বেশি বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করে অধ্যাপক শফি বলেন, কোভিডে বাচ্চাদের মাইল্ড সিম্পটম হয় এবং তাদের ঝুঁকিটা কম থাকে। কিন্তু ডেঙ্গুতে শিশুরা অনেক ঝুঁকিতে থাকে।
হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২১৮ জন। এর মধ্যে ঢাকায় আক্রান্ত ২০৮ জন, ঢাকার বাইরে ১০ জন। বর্তমানে দেশের হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছেন ১ হাজার ৫৫ জন। এর মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১ হাজার ১২ জন। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৯০১ জন।
গতকাল পর্যন্ত স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৪৬৩ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি ১৫৫ জন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ৪১ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি ১৩৮ জন। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৮১২ জন, বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ২ হাজার ৯৪৫ জন। রাজধানীর বাইরে ঢাকাসহ অন্য বিভাগের হাসপাতালে ভর্তি ১৪৪ জন।
ডা. শফি আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, শিশুর জ্বর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে না কমলে অবশ্যই ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। ডেঙ্গু হলে শিশুর বমি, কালো পায়খানা এবং রক্তক্ষরণ হয়। প্লাটিলেট কমে গেলে অবস্থা গুরুতর হয়। তিনি মশা নিধন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বাড়িতে মশারি ব্যবহার করার এবং শিশুদের ফুল প্যান্ট ও ফুল হাতার জামা পরানোর পরামর্শ দেন।
এমন পরিস্থিতিতে দেশের স্বনামধন্য চিকিৎসক অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেছেন, জ্বর হলে অবহেলা করা যাবে না। অমুক ওষুধ খেলে জ্বর ভালো হয়ে যাবে, এজাতীয় ভাবনা যে কারো জন্যে ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অবহেলা করে ঘরে বসে থাকা যাবে না। জ্বর হলে ডাক্তার দেখাতেই হবে। অন্তত ডেঙ্গু হয়েছে কী না তা পরীক্ষা করে নিতে হবে। জ্বর হলেই আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। এমনকি ডেঙ্গু হলেও আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই যদি চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যায়।
তিনি বলেন, আরেকটি বিষয় হলো- ডেঙ্গু জ্বরের সময় ভীষণ ব্যথা হয় বলে অনেকে বিভিন্ন রকমের ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে থাকেন। নিয়ম হচ্ছে এমন পরিস্থিতিতে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না। তা না হলে পরিস্থিতি বিপদজনক হতে পারে। জ্বর হলে কী ধরনের খাবার খাবেন, সে বিষয়েও ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু করা যাবে না।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট আইইডিসিআরের প্রধান ডা. তাহমিনা শিরিন বলছেন, ডেঙ্গু ও করোনা-এই দুটো রোগেরই উপসর্গে কিছু মিল রয়েছে। বিশেষ করে আক্রান্ত হওয়ার শুরুর দিকে। কিছুদিন আগেও জ্বর, মাথা ব্যথা, গলা ব্যথা, শরীর ব্যথা হলেই আমরা বলতাম কোভিড টেস্ট করেন। আমরা এখন যেটা করছি, এসব উপসর্গ দেখলে করোনা এবং ডেঙ্গু দুটোর জন্যই পরীক্ষা করাতে বলছি।
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেছেন, সুস্থতার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে এডিস মশা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধ করতে হবে। সুস্থতার জন্য সুস্থ পরিবেশের কোনো বিকল্প নাই, আর সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম সংক্রান্ত সামাজিক আন্দোলনে সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
তিনি বলেছেন, সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে "দশটায় ১০ মিনিট প্রতি শনিবার, নিজ নিজ বাসাবাড়ি করি পরিষ্কার" এই স্লোগানটিকে বাস্তবায়ন করতে হবে। ব্যক্তিগত, সরকারি কিংবা বেসরকারি যেকোনো ভবনেই এডিসের লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেলে জরিমানাসহ প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে।