রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে অপ্রতিরোধ্য দালাল চক্র: যা জানা যাচ্ছে
বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের মংডুসহ বিস্তৃত সীমান্ত আরাকান আর্মির দখলে যাওয়ায় বাংলাদেশমূখি রোহিঙ্গাদের ঢল বাড়ছে। তবে সীমান্ত রক্ষীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া অবস্থান সত্ত্বেও সীমান্তে সংঘবদ্ধ চক্রের দুর্নীতির কারণেই এই অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না বলে জানালেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
রোববার (২২ ডিসেম্বর) পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, দুর্নীতির কারণে স্থল-জলসীমাসহ সীমান্তের নানা রুট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আটকানো খুব কঠিন হচ্ছে।
তৌহিদ হোসেন বলেন, আমাদের নীতিগতভাবে অবস্থান ছিল আর কোনো রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দেব না। তবে পরিস্থিতি কখনো কখনো এমন দাঁড়ায় যে আমাদের কিছু আর করার থাকে না। সে রকম পরিস্থিতিতে আমরা ৬০ হাজার রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দিয়েছি। আনুষ্ঠানিকভাবে যে তাদের ঢুকতে দিয়েছি, তা–ও নয়, তারা বিভিন্ন পথে ঢুকেছেন।
সীমান্তে দুর্নীতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা অস্বীকার করার কোনো অর্থ নেই-দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর ঢুকে যাচ্ছে (রোহিঙ্গারা)। নৌকা নিয়ে ঢুকছে। তবে একটা সীমান্ত দিয়ে যে ঢুকছে বিষয়টা এমন নয়। বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে যে ঢুকছে এটা আটকানো খুব কঠিন হচ্ছে।
‘তবে আমি মনে করি না আর একটি ঢল আসবে। যদিও অনেকে আশঙ্কা করছেন। এই আশঙ্কা আমাদেরও আছে। তবে সেই ঢলকে আটকানোর ব্যবস্থা করতে হবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়েই’-বলেন পররাষ্ট্র উপেদষ্টা।
তৌহিদ হোসেন বলেন, এখন বয়স্ক যেসব রোহিঙ্গা আছেন, তারা হয়তো পরিস্থিতি মেনে নেবেন। তবে আগামী ৫ বছর পর যেসব তরুণ রোহিঙ্গার বয়স ২০ বছর হবে, তারা বেপরোয়া হয়ে উঠবেন। তখন আমাদের সমস্যা বেশি হবে ঠিকই, তবে সেই সমস্যা প্রত্যেকেরই হবে।'
মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থান সোয়ের সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘তাকে (থান সোয়ে) বলেছি মিয়ানমার সীমান্তে তো তোমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। সীমান্ত তো রাষ্ট্রবহির্ভূত শক্তির (নন–স্টেট অ্যাক্টর) নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। রাষ্ট্র হিসেবে তো আমরা নন–স্টেট অ্যাক্টরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি না। কাজেই তাদের দেখতে হবে কোন পদ্ধতিতে সীমান্ত ও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে।’
ব্যাংককে মিয়ানমারের সাথে সীমানা থাকা পাঁচটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ইনফরমাল কনসালটেশনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আগামী এক দশক পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। তাতে আঞ্চলিক সব দেশই ক্ষতির মুখে পড়বে।’
অনুপ্রবেশে সক্রিয় দালালচক্র সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে
এদিকে, রোহিঙ্গা ঢল বন্ধ করতে কক্সবাজারে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম ইতোমধ্যে স্থগিত করা হয়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কী করা যায়, তা নিয়ে আগামীকাল মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জরুরি বৈঠকে বসছেন রোহিঙ্গাবিষয়ক ন্যাশনাল টাস্কফোর্সের সদস্যরা।
কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অধিকাংশ এলাকাসহ আঞ্চলিক সেনাসদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। বাংলাদেশ ও মায়ানমারের পুরো সীমান্ত এলাকা এখন তাদের দখলে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্ত কীভাবে পরিচালিত হবে, সীমান্তে চোরারচালান ও মাদক প্রতিরোধ এবং সীমান্ত বাণিজ্য কীভাবে চালানো হবে তা নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে আরাকান আর্মির সঙ্গে। তবে এই আলোচনা শুধুমাত্র গোয়েন্দা পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, নাফ নদে কড়াকড়ি পাহারা থাকায় পাহাড়ি পথে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। মংডু শহর এএ’র দখলে চলে যাওয়ার পরও কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার সীমান্তে থেমে নেই গোলার বিকট শব্দ। বন্ধ হচ্ছে না বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গা স্রোত। বান্দরবান জেলার পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে এবার রোহিঙ্গার পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনও ঢুকছে। গত ১৮ নভেম্বর বান্দরবানের ঘুমধুম বাইশফাঁড়ি সীমান্ত দিয়ে তঞ্চংগ্যা ও বড়ুয়া সম্প্রদায়ের অর্ধশতাধিক নাগরিক অনুপ্রবেশ করে উখিয়ায় অবস্থান করছে।
সীমান্তের বাসিন্দারা জানান, রোহিঙ্গারা নানা কৌশলে অনুপ্রবেশ করছে। এমনকি রাতের আঁধারে সাঁতরে বাংলাদেশে আসছে। আবার মংডুতে রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে আরাকান আর্মিও বাণিজ্যে নেমেছে। যেসব রোহিঙ্গা তাদের অর্থ দিচ্ছে, তাদের বাংলাদেশ সীমান্তে আসার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে তারা।
আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর একাধিক সংস্থার সদস্যরা বলছেন, বান্দরবান সীমান্তের পাহাড়ি এলাকার নাইক্ষ্যংছড়ি, ঘুমধুম, তুমব্রু, জামছড়ি, লেবুছড়ি, আলীকদম, পশ্চিমকুল সীমান্তে পাহাড়ি অঞ্চলসহ টেকনাফের হোয়াইক্যং ও হ্নীলা এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গারা ঢুকছে। এসব সীমান্তে একাধিক দালাল সক্রিয় রয়েছে। তারা ২০-৩০ হাজার টাকা নিয়ে তাদের সুযোগ করে দিচ্ছে।
সূত্রগুলো আরও জানায়, মায়ানমারের দালালের পাশাপাশি এপারেও অনেক দালাল রয়েছে। তাদের মধ্যে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের জলপাইতলী এলাকায় জকির আহমদ সিন্ডিকেট প্রধান ও কামরুল হাসান সোহেল, নুরুল আমিন ওরফে মনিয়া, ইসমাইল, ইব্রাহিম, সরওয়ার, দেলোয়ার, বাইশফাঁড়ির জকির আহমদ জাহাঙ্গীর, আলমগীর, শাহ আলম ওরফে রাঙ্গা শাহ আলম, রাসেল, কামরুল হাসান সোহেল, ছৈয়দ আলম, উসিংলা, মংসিং তঞ্চংগ্যা, মোবারকসহ অনেকে রয়েছে।