শরীরে ১৮শ’ স্প্লিন্টারের যন্ত্রণায় দুর্বিষহ মাহাবুবার জীবন

, জাতীয়

উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সাভার (ঢাকা) | 2023-09-01 12:00:48

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় শরীরে এখনো ১৮শ’ স্প্লিন্টার নিয়ে বেঁচে থাকা ঢাকা জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেত্রী সাভারের মাহাবুবা পারভীন চলাফেরা করেন অন্যের সহযোগিতায়। ১৭ বছর ধরে স্প্লিন্টারগুলো যন্ত্রণা দেয় মাহবুবা পারভীনের শরীরে।

সেদিনের অভিশপ্ত স্মৃতিগুলো ঢাকার অদূরে সাভার পৌর এলাকার ব্যাংক কলোনী মহল্লার ৩৬ নাম্বার বাড়িতে বসে প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপ করছিলেন মাহবুবা পারভীন।

২০০৩ সালে বর্তমান সাভার পৌর মেয়র হাজী আব্দুল গণির মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতেখড়ি মাহবুবার। তারপর থেকেই রাজনৈতিক বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। ২০০৪ সালে মাহবুবা ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা ছিলেন। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে ঢাকায় সভানেত্রীর বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতেন তিনি। ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশে মাহবুবা অংশ নিয়েছিলেন বেলা ১২টায়। বিকেল ৩টায় সমাবেশ শুরু হয়। তবে গ্রেনেড হামলার সময় মঞ্চের নিচে ছিলেন মাহবুবা। হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় গ্রেনেড। এর কিছু সময় পর রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।

মাহবুবা বলেন, সেদিন কেউ ভাবেনি আমি বেঁচে আছি। ভ্যানে করে অন্য সবার সঙ্গেই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। সেই সময় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আশীষ কুমার মজুমদারকে আমার পরিবারের সদস্যরা ফোন দেয়। তখন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়ে আমার লাশের খোঁজ করছিলেন। কিন্তু দেখলেন দ্বিতীয় তলায় ফ্লোরে আমি শুয়ে আছি। তখন আমার চিকিৎসার জন্য অন্য হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টা করলেন। কিন্তু স্প্লিন্টারে ক্ষত-বিক্ষত দেখে হাসপাতালে ভর্তি নিচ্ছিল না। পরে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

মাহাবুবা পারভীন জানান, আহত অবস্থায় তাকে শেখ হাসিনার নির্দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় ভারতের কলকাতায় অবস্থিত পিয়ারলেস হাসপাতালে। সেখানে তাকে প্রায় ২৫ দিন চিকিৎসা দেওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানায় মাথায় তিনটা স্প্লিন্টার আছে। সেই সঙ্গে শরীরে ১৮শ’ স্প্লিন্টার রয়েছে। শরীর ফিট না থাকার কারণে আরো ছয় মাস পরে গিয়ে স্প্লিন্টার বের করা এবং ব্রেনের চিকিৎসার জন্য সম্ভব হলে ব্যাংকক যেতে পরামর্শ দেন সেখানকার বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা।

ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া মাহাবুবা পারভীন বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ১৭ বছর হয়ে গেছে কিন্তু শরীরে গ্রেনেডের ক্ষত বহন করে চলছি। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করি। বিভীষিকাময় সেই দিনটির কথা মনে পড়লে ঘুমের ঘরে মাঝেমধ্যেই আঁতকে উঠি। আইভি আপা মরে বেঁচে গেছেন, আর আমি বেঁচেও মরে আছি। এখন আমি অর্ধমৃত একটা আহত মানুষ।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে তার কন্যার মতো ভালোবাসেন। তিনি দুই বার ১০ লাখ করে ২০ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন এবং প্রতিমাসে চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার করে টাকা দেন। পাশাপাশি থাকার জন্য মিরপুরে ১৪০০ স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছেন।

তবে মাহাবুবা পারভীনের দুঃখ স্থানীয় সংসদ সদস্য কিংবা দলীয় নেতৃবৃন্দ তার কোনো খোঁজ-খবর নেন না, এমনকি কোনো মিটিং মিছিলেও তাকে ডাকেন না। অসুস্থ হয়ে ঘরে শুয়ে বসে থাকতে ভালো না লাগায় এখনো দলীয় বিভিন্ন প্রোগ্রামের খবর শুনলেই তিনি ছুটে যান সেখানে যোগ দিতে। তবে তার ভাষায় বর্তমানে আওয়ামী লীগের সুসময়ের কোকিলেরা তার মতো ত্যাগী কর্মীকে বসার জন্য স্টেজে একটি চেয়ারও দেয় না।

তিনি বলেন, ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরিকল্পনা করা হলেও ভাগ্যক্রমে আমার নেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা আপা দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান। যে কারণে পরবর্তীতে তাদেরকে হত্যার জন্য ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। যদি ১৫ আগস্ট শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে মীরজাফরেরা হত্যা করতে পারতো তাহলে আর ২১ আগস্টের সৃষ্টি হতো না। তাই আমি মনে করি ১৫ আগস্ট এবং ২১ আগস্ট একই সূত্রে গাথা। পাকিস্তানিরা যেখানে আমার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলো না, সেখানে বাংলাদেশের ক্ষমতা দখলের লোভে জিয়াউর রহমান ও মেজর ডালিমসহ কতিপয় সেনা সদস্যরা শিশু রাসেলসহ সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। আমি এসব হত্যাকারীদের দ্রুত বিচার প্রার্থনা করছি।

মাহাবুবা পারভীন বলেন, কালকে যদি তারেক জিয়ার ফাঁসি হয়, আমার মনে হয় আমি সুস্থ হয়ে যাব। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় আমি বাবর, আব্দুস সালামসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছি এবং আদালতে বলেছি এই হামলার মূল হোতা তারেক জিয়া কোথায়? আমি তার ফাঁসি চাই। মৃত্যুর আগে এই হামলাকারীদের ফাঁসি দেখে যেতে চাই। কেন তাকে এখনো বিদেশ থেকে দেশের মাটিতে ফিরিয়ে এনে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। বিনা অপরাধে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরিকল্পনাকারী খুনি জিয়াউর রহমানের ছেলে খুনি তারেক রহমান ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জন নেতাকর্মীকে হত্যাসহ অসংখ্য মানুষকে আহত ও পঙ্গু করেছে। বিনা অপরাধে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের স্বজন এবং আমরা যারা আহত হয়েছি সবারই একটাই দাবি আমরা খুনি তারেক রহমানের ফাঁসি দেখে মরতে চাই।

গ্রেনেড হামলায় আহত স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেত্রী মাহাবুবা পারভীন বলেন, হামলায় আহত হয়ে পড়ে থাকার সময় শত শত লোক প্রাণ বাঁচাতে ছুটোছুটি করে তার পা এবং শরীরের উপর দিয়ে গিয়েছে। বেঁচে থাকার কারণে আজও সেই ব্যথা তাকে দুঃসহ যন্ত্রণা দেয়। মাঝে মধ্যেই ব্যথার কারণে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলে আশপাশের লোকজন জড়ো হয়ে যায়। এখনো তিনি পায়ের ব্যথার জন্য সিআরপির চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী থেরাপি নিচ্ছেন। চিকিৎসক বলেছেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ব্যথার জন্য এভাবেই তাকে থেরাপি দিয়ে যেতে হবে।

মাহবুবার জানালেন, গ্রেনেড হামলায় তার শরীরে ১৮শ’ স্প্লিন্টার বিদ্ধ হলেও পরবর্তীতে পায়ের চিকিৎসা করানোর সময় তিনটি স্প্লিন্টার বের করা হয়েছে। এখনো তার ঘাড়, মাথাসহ বিভিন্ন স্থানে আরও ১৭৯৭টি স্প্লিন্টার রয়ে গেছে। নিজের রান্না নিজেই করেন মাহাবুবা, কিন্তু শরীরে স্প্লিন্টার থাকার কারণে বেশিক্ষণ রান্নাঘরে থাকতে পারেন না।

মাহাবুবা বলেন, গ্রেনেড হামলায় আহত হলে হার্ট অ্যাটাক হয়। ৭২ ঘণ্টা আইসিউতে ভর্তি ছিলাম আমি। এরপর থেকেই শরীরের বাম পাশ প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেছি। বর্তমানে সেই অবস্থার উন্নতি হওয়ায় লাঠিতে ভর দিয়ে চলাচল করলেও এখনো বাম পায়ের হাঁটুতে মাঝে মধ্যে কট করে শব্দ হওয়ায় মনে হয় ভেঙে যাবে। এছাড়া শুয়ে থাকলে কাত কিংবা চিত হতে পারি না।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে আহত মাহাবুবা পারভীন বলেন, আমি রাজনীতি করতে গিয়ে সাভারের নেতাকর্মীদের ভালোবাসা না পেলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অপার ভালোবাসা পেয়েছি। তার দাবি, সাভারের বর্তমান কিংবা সাবেক সংসদ সদস্য কেউই তাকে সহযোগিতা তো দূরের কথা ফোন করে খবরও নেননি। তবে বর্তমানে সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীব মাঝে মধ্যে তার খোজখবর নেন। তাছাড়া অন্য কেউ খোঁজ নেন না।

মাহাবুবা পারভীন বলেন, গ্রেনেড হামলার ১৭ বছর হয়ে গেছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ তাকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করেনি। নেতাকর্মীরা এখন আর তার খোঁজখবর নেন না। জীবনের অনেক অপূর্ণতা থাকলেও মাহাবুবা পারভীনের একটিই চাওয়া, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে বুকে ধারণ করে বেঁচে থাকা।

প্রসঙ্গত, চার ভাই বোনের মধ্যে মাহাবুবা পারভীন ৪র্থ। শরীরে ক্ষত নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন তিনি। পাশাপাশি আর্থিক অভাব-অনটনের মধ্যে নিজের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। মাহাবুবা পারভীনের দুই ছেলে আসিফ পারভেজ ও রুশাদ জোবায়ের। তার প্রয়াত স্বামী এম এ মাসুদ বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট ছিলেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর