সময় যত গড়াচ্ছে রাজধানীর ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৃত্যু ও আক্রান্ত বিবেচনায় পুরাণ ঢাকার যাত্রাবাড়ী, ধোলাইপাড়, শনির আখড়া, জুরাইন ও মুরাদপুরকে ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন কিটতত্ত্ববীদেরা।
এর মধ্যে পুর্বজুরাইনের অবস্থা সব থেকে বেশি ঝুকিপূর্ণ ও শোচনীয়। গত আগস্টে শিশু ও বৃদ্ধসহ ৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন জুরাইন এলাকায়। এছাড়াও প্রত্যেকদিনই কেও না কেও নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেই। মিডফোর্ড হাসপাতালের ডেঙ্গু ইউনিটে চিকিৎসারত অধিকাংশ রোগি জুরাইন ও পার্শ্ববর্তী এলাকার।
পুর্বজুরাইন তো বটেই হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা এলাকার প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে দুই থেকে একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বাড়ি কিংবা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ঢাকার মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মাঝ বয়সী পুরুষের মৃত্যু হার সবচেয়ে বেশি।
পূর্বজুরাইনের কমিশনার গলির জয়নাল আবেদিন জানান, এই এলাকায় প্রত্যেক ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী। সারাদেশ যখন করোনা নিয়ে আতঙ্কে আছে তখন আমরা ডেঙ্গুর সাথে যুদ্ধ করছি।
এই এলাকায় করোনার থেকেও বড় আতঙ্ক ও মহামারি এখন ডেঙ্গু। আমাদের এক ফ্যামিলিতে চারজন ডেঙ্গু আক্রান্ত । এর মধ্যে দুইজন কিছুটা সুস্থ হলেও বাকিদের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এক সপ্তাহের মধ্যে চারজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ায় পুরো ফ্যামিলি খুব বিপদের মধ্যে আছি। ৩৫ বছর বয়সি জামাতা ,১৬ বছর বয়সি ভাগ্নে এবং ১৯ বছর বয়সি মেয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পরেই তাদের শরীরে কমতে থাকে প্লাটিলেট।
কাছাকাছি সময়ে এত মানুষের জন্য প্ল্যাটিলেট যোগার করাটা খুবই কঠিন কাজ হয়ে গেছিলো, আল্লাহর রহমতে যোগার করতে পেরেছিলাম। না হলে আমাদের খুবই খারাপ পরিস্থিতে পড়তে হতো।
অন্যদিকে, হাতে মেডিকেল টেস্টের কাগজপত্র নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছিলেন ডেঙ্গু থেকে সদ্য সেরে ওঠা ৪৮ বছর বয়সি মিজানুর রহমান। পুর্বজুরাইনের কমিশনার গলিতে অন্যদের সাথে কথা বলতে দেখে নিজেই এগিয়ে এসে বললেন, আমি চার দিন হলো ডেঙ্গু থেকে সেরে উঠেছি কিন্তু শরীরটা ভীষণ দূর্বল তাই আবারও হাসপাতালে যাচ্ছি। জ্বর থেকে ভালো হলেও দূর্বলতার কারনে কোথাও বেশিক্ষণ দাড়িয়েও থাকতে পারি না।
শুধু আমি না, আমার বাড়িতে ১৬ বছরের ভাতিজাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এতটা দূর্বল হয়েছে যে, জোরে কথাও বলতে পারে না। এছাড়া আমার ছোট ভাই ও বড় ভাবি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। ইতিমধ্যেই পরিবারের চারজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছি। এরপর আরো কয়েকজন জ্বর ও শরীর ব্যাথার কথা বলছে, আশংকা করি তারাও ডেঙ্গু আক্রান্তই হবেন।
এদিকে ধোলাইপাড় ও শনির আখড়া এলাকার অবস্থাও একই উল্লেখ করে ধোলাইপাড়ের বাসিন্দা শায়ের সারোয়ার প্রান্ত বলেন, আমাদের এলাকার আশেপাশে অনেক বাড়িতেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। দুই,একটা বাড়ি পরেই এক,দুইজন করে আক্রান্ত।
দিনের বেলা ঘরে মশারি টানিয়ে বা কয়েল জ্বালিয়ে রেখেও রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে শুধু ধোলাইপাড় বা শনির আখড়া না সারা পুরান ঢাকায় ডেঙ্গু একটা মহামারি আকার ধারণ করবে বলে মনে করি।
রাজধানীর ডেঙ্গু পরিস্থিতি জানাতে গিয়ে কিটতত্ত্ববীদ প্রফেসর কাবিরুল বাশার বার্তা২৪.কম-কে বলেন, রাজধানীর ধোলাইপাড়, শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ী, জুরাইন ও মুরাদপুর ডেঙ্গুর হটস্পটে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে জুরাইনের অবস্থা সব থেকে বেশি খারাপ।
এর কারণ হলো, জুরাইনের যে বাড়িগুলো আছে সেগুলোর নিচতলা রাস্তার থেকেও প্রায় এক কোমড় নিচে। বর্ষার মৌসুম হওয়ায় এসব বাসার নিচ তলায় পানি জমে গেছে এবং এই জায়গাগুলোতেই বেশি এডিস মশা হচ্ছে। এটাই হচ্ছে জুরাইনের মূল সমস্যা।
জুরাইনবাসি হয়তো বুঝতেই পারছে না এসব কারনে তাদের ঘরের মধ্যেই এডিস হয়ে বসে আছে। এডিস মশা জন্মানোর জন্য কোন একটা পাত্রের জমা পানি হতে হবে।এটা বেইজইমেন্টের ফ্লোরও হতে পারে বা লিফটের গর্ত বা ড্রাম, বালতিতেও জমা পানি হতে পারে।
তিনি আরো বলেন, জুরাইনসহ আশেপাশের এলাকায় যেভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে সেটা খুব ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এটা থেকে মুক্তির জন্য সব সময় মশারি ব্যাবহার করতে হবে না হলে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত মশা নিয়ন্ত্রণ না হবে ততদিন পর্যন্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।
আক্রান্ত ও মৃত্যু ঝুঁকি কমাতে শুধু জুরাইন বা পুরাণ ঢাকার বাসিন্দা না সারা নগরবাসির জন্য একটাই পরামর্শ নিজেদের ঘর ও বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখা। সপ্তাহে একদিন সারা বাড়ি ঘুরে দেখে বের করতে হবে কোথাও কোন পানি জমা রয়েছে কী না। থাকলে সেগুলো দ্রুত নিষ্কাশন করতে হবে। আরো একটি বিষয় খুবই গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে । যদি কারো বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী থাকে তাহলে সব সময় মশারির ভেতরে রাখতে হবে যেন কোনভাবেই তাকে মশা কামড়াতে না পারে।
কীটতত্ত্ববীদ ও বিশেষজ্ঞরা শুধু পুরাণ ঢাকার এইসব অঞ্চলকে হটস্পট বিবেচনা করলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেব ও জরিপ অনুয়াযী, ঢাকা দক্ষিণ সিটির যাত্রাবাড়ি ও জুরাইন এলাকা এবং উত্তর সিটির মধ্যে বড় মগবাজার ও ইস্কাটনে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যু সব থেকে বেশি। যদিও অধিদপ্তর এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেনি এখনো।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কম-কে এসব জানিয়ে বলেন, পুরো ঢাকার এই চার অঞ্চলকে 'হটস্পট' হিসেবে বিবেচনা করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ঢাকার মধ্যে এসব এলাকায় আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু মৃত্যুর হার বেশি থাকলেও এখন শিশু আক্রান্তের হার বেশি। আর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এখন সব থেকে বেশি মারা যাচ্ছে মধ্য বয়স্ক পুরুষ।
রাজধানীতে ডেঙ্গুর হটস্পটগুলোর ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ও অধিদপ্তরের মুখপাত্র প্রফেসর ডাক্তার নাজমুল ইসলাম বার্তা২৪.কম-কে বলেন, এটা আসলে দেখে বলতে হবে। কারণ ঢাকার মধ্যে বিভিন্ন জায়গা থেকে আমরা বিভিন্ন তথ্য পেয়েছি। হটস্পট বা ঝুঁকির তো বিষয় না, আসলে যারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকছে তারা নিরাপদ আর যাদের বাড়ির আশেপাশে বৃষ্টির পানি জমে থাকছে বা অন্য উপায়ে পানি জমে থাকছে তারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। উত্তর ও দক্ষিণ দুই সিটিতেই ডেঙ্গুর প্রকোপ আছে। তবে এটা নিয়ন্ত্রনে থাকবে কী না সেটা নির্ভর করে দুই সিটি করপোরেশনের তৎপরতার উপরে।
পুর্ব জুরাইন ও পুরাণ ঢাকার ডেঙ্গু পরিস্থিতির বিষয়ে অবগত আছেন কী না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে দেখেন এসব এলাকায় আমরা শুধু সার্ভেটা করে দেই। ব্যাবস্থাটা নেয় সিটি কর্পোরেশন এবং ওখানে চিরুনি অভিযান বলেন কিংবা অন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যাবস্থা ওনারাই (সিটি কর্পোরেশন) করে থাকেন। আমরা শুধু তথ্য দিয়ে সার্বিক বিষয়টা জানিয়ে দেই। অলরেডি আমরা প্রিমুনসুন ও মুনসুন দুইটাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ্য থেকে দিয়েছি সিটি করপোরেশনকে। ওনারা সেটা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
উল্লেখ্য, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী গতকাল ঢাকার শনিবার পর্যন্ত শুধু ঢাকাতেই বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছে এক হাজার ১৩৭ জন। আর বাকি ১৩৬ জন ঢাকার বাইরে অন্য বিভাগে। গতকাল নতুন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে আরো দুই জন। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৫১ জন। এবছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১১ হাজার ৫০১ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন এবং ছাড়া পেয়েছেন ১০ হাজার ১৭৪ জন।