রয়েল টিউলিপের সার্ভিস ‘জাস্ট ফালতু’

, জাতীয়

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-09-01 23:52:38

বাইরের চাকচিক্য দেখে যারাই আকৃষ্ট হচ্ছেন, ভেতরে প্রবেশ করে ঠিক ততটাই হতাশ হয়ে যাচ্ছেন। আর এ কারণেই ইন্টারন্যাশনাল চেইন ‘গোল্ডেন টিউলিপ’ তার ফ্রাঞ্চাইজি প্রত্যাহার করে নিয়েছে হোটেলটি থেকে।

সে কারণে রয়েল টিউলিপ নাম ব্যবহার করার সুযোগ নেই পাঁচতারকা দাবিদার এই হোটেলটির। তবে কাগজপত্র দেখে যে কেউ বিভ্রান্ত হতে পারেন। একই কাগজে একাধিক জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। কোন জায়গায় সী পার্ল বীচ রিসোর্ট এন্ড স্পা লিমিটেড লেখা। আবার কোথাও রয়েল টিউলিপ সী পার্ল বীচ রিসোর্ট এন্ড স্পা লিমিটেড রয়ে গেছে। একে কৌশলে প্রচার বলে মনে করছেন অনেকেই। আমাদের সঙ্গে সম্পাদিত বিক্রয় চুক্তিতে পরিচালক (সেলস এন্ড মার্কেটিং) স্বাক্ষর করেছেন অন বিহ্যাভ অব রয়েল টিউলিপ সী পার্ল বীচ রিসোর্ট এন্ড স্পা লিমিটেড লিখে। চুক্তির কপির মূল হেডে লেখা সী পার্ল বীচ রিসোর্ট এন্ড স্পা লিমিটেড। ভেতরে চার জায়গায় রয়েল টিউলিপ লেখা। আবার ফোন দিলেই ওয়েলকাম টিউন শোনানো হচ্ছে রয়েল টিউলিপ সী পার্ল বীচ রিসোর্ট এন্ড স্পা লিমিটেড বলে।

কাড়ি কাড়ি টাকা গুণেও যখন কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলছে না, তখন স্বাভাবিকভাবেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে অতিথিরা। একবার গেলে আর দ্বিতীয়বার যেতে চাইছেন না। এটিএন বাংলার বিশেষ প্রতিনিধি ফজলে রাব্বী বার্তা২৪.কম-কে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেছেন, এক কথায় বলতে হলে বলবো সার্ভিস জাস্ট ফালতু। করিডোরে পিন পড়েছিল। সেই পিন আমার পায়ে ফুটো করে ঢুকে পড়ে। প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে রুমে ফিরি, পাঁচ তারকা হোটেলে ডাক্তার থাকা বাধ্যতামূলক। রাতে তাদের মেডিকেল সার্ভিসে (১১১) ফোন দিয়ে জানতে পেলাম ডাক্তার নেই। শেষ পর্যন্ত একটি পেইনকিলার ট্যাবলেট চাইলাম, পাঠাতে চাইলেন ঘণ্টা খানেক সময় চলে যায় আর আসে না। এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছি রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঘুম ভাঙিয়ে একটি প্যারাসিটামল দিয়ে গেছে। পেশাগত কারণে জীবনে অনেক হোটেলে রাত্রীযাপন করেছি। এই হোটেলের মতো ফালতু অভিজ্ঞতা হয়নি।

জুতা ফুটো কর পায়ে পিন ঢুকে

দ্বিতীয়বার এই হোটেলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না বলে মন্তব্য করেছেন গাজী টিভির রিপোর্টার ফেরদৌস আরেফিন। তিনি বলেছেন, চেক আউট পয়েন্টে যে লোকটি ছিল তার দুর্ব্যবহার জীবনে ভুলতে পারবো না। আমার শার্টল ধরার কথা আগেই জানানো ছিল, চেক আউট হয়ে নামতে গিয়ে ৫ মিনিট দেরি হয়। প্রথমেই আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, আপনার জন্য কি গাড়ি বসে থাকবে। গাড়ি চলে গেছে এখন নিজের ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে। সঙ্গে স্ত্রী থাকায় বিতর্কে জড়ায়নি। বাইরে গিয়ে সিএনজি ভাড়া করে আনার পর নিরাপত্তাকর্মী জানালো আপনিতো শাটলেই যেতে পারতেন। আপনি যখন সিএনজি ডাকতে গেছেন তখন শার্টল গেছে। পরে জেনেছি ওরা নাকি এই কাজটি ইচ্ছা করেই করে। সিএনজি ও অটো চালকদের সঙ্গে সিন্ডিকেট রয়েছে, যাতে বাধ্য হয়ে বেশি টাকা দিয়ে এয়ারপোর্ট যেতে বাধ্য হন। আমিও দ্বিগুণ ভাড়া গুণতে বাধ্য হয়েছি। অথচ তখন শার্টলটি দাঁড়ানো ছিল। আমি বাসটি দেখলাম ওই শার্টল বাসের একজন স্টাফ আমার লাগেজ গাড়িতে তুলতে গেলে ধমক দিয়েছিল কাউন্টারে থাকা লোকটি। আগের দিনে রুম ক্লিন করে দেয়নি। রুম সার্ভিসকে যখন বললাম, জবাব দিলেন রুম ক্লিন করতে চাইলে জানাতে হবে। না হলে রুম ক্লিন করা হয় না।

আরেকজন অতিথি অভিযোগ করেছেন, তিনি যাওয়ার আগেই এক্সট্রা বেডের রিকুজিশন দিয়ে গিয়েছিলেন। বিকেলে উঠে আবার বলেছেন, সেই বেড পেয়েছেন মধ্যরাতে। এক্সট্রা বেডের জন্য সকালের নাস্তা ফ্রি। প্রথম দিনের কুপন দিলেও দ্বিতীয় দিন আর দেননি ।

এ বিষয়ে ডিউটি ম্যানেজার (নাইট ম্যানেজার) নাফিস মাহমুদ শাহরিয়ার বার্তা২৪.কম-কে বলেন, এক্সট্রা বেডের জন্য প্রথম দিনের কমপ্লিমেন্টারি নাস্তার কুপন দেওয়া হয়। দ্বিতীয় দিন নিতে হলে যোগাযোগ করতে হবে। বেশ দম্ভের সঙ্গে নিয়ম বাতলে দিলেন ওই কর্তা।

হোটেলের একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, অতীতে নাকি সার্ভিস আরও খারাপ ছিল। যে কারণে জিএম পরিবর্তন হয়েছে। একজন অস্ট্রেলীয়ান নাগরিককে দায়িত্বে আনা হয়েছে, তিনি এসে কিছু কিছু দক্ষ স্টাফ নেওয়া শুরু করেছেন। তবে অনেকেই নাকি তদবিরে চাকরি পেয়েছেন যে কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। মালিক পক্ষও অব্যবস্থাপনা বিষয়ে অবগত।

বাইরের চাকচিক্যের সঙ্গে যেমন ভেতরের বাস্তবতার মিল নেই, তেমনি বিশাল স্থাপনা দেখে বুঝবার জো নেই পুরো বিনিয়োগটি পেন্ডুলামের মতো ঝুলছে। ঋণের কিস্তি দিতে না পেরে নিলামে উঠবার জোগাড় হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের স্পেশাল পারপাস ভেহিকল (এসপিভি) জিটি ইনভেস্টমেন্টের সঙ্গে ফ্র্যাঞ্চাইজি চুক্তির ভিত্তিতে যাত্রা শুরু করে রয়েল টিউলিপ সী পার্ল বীচ রিসোর্ট এন্ড স্পা লিমিটেড। ব্যাংকের কাছ থেকে উচ্চসুদে ব্রিজ ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে অর্থ নিয়ে হোটেলটি স্থাপন করা হয়। হোটেল ব্যবসা থেকে আসা নগদ প্রবাহ দিয়ে ব্যাংকের উচ্চসুদের ঋণ পরিশোধ করা প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে কঠিন হয়ে পড়লে এগিয়ে আসে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ লিমিটেড (আইসিবি)। ২০১৭ সালে বন্ডের মাধ্যমে ৩২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে আইসিবি। এই বিনিয়োগের টাকায় ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ ও রুমের ইন্টেরিয়র করা হয়। আইসিবির বিনিয়োগের ২ বছর পর প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকেও তহবিল সংগ্রহ করে হোটেলটি। আইসিবিকে ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১০৮ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। ২০২০ সালের মার্চে প্রথম কিস্তি পরিশোধের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত পরিশোধ করা হয়নি। দফায় দফায় চিঠি দিলেও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা হচ্ছে না। এ কারণে তারল্য সংকটে থাকা আইসিবি নিজেই এখন বিপাকে পড়েছে। প্রয়োজনে স্থাবর অস্থাবর জব্দের মাধ্যমে টাকা আদায়ের পথে হাঁটা শুরু করেছে আইসিবি। তেমনটি হলে অদূর ভবিষ্যতে নিলামে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

হোটেলের পক্ষ থেকে করোনার কারণ দেখিয়ে সুদ মওকুফের আবেদন জমা দিয়েছে। তারা চাইছে সুদ মওকুফ করে প্রকৃত ঋণের টাকা সহজ কিস্তিতে পরিশোধ করতে। সী পার্ল বীচ রিসোর্ট এন্ড স্পা লিমিটেডের কোম্পানি সচিব আজাহারুল মামুন বার্তা২৪.কম-কে বলেন, আমরা সুদ মওকুফের আবেদন করেছি এখনও কোনো সিদ্ধান্ত পাইনি।

এখন পর্যন্ত আইসিবির কোনো কিস্তি পরিশোধ করা হয়নি বলে স্বীকার করেন কোম্পানি সচিব আজাহারুল মামুন।

আরও পড়ুন: হোটেল রয়েল টিউলিপ-৪২০

এ সম্পর্কিত আরও খবর