উত্তরপূর্বের সহিংস-অস্থিরতা আঞ্চলিক শান্তুি, স্থিতি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ

, জাতীয়

আবুল খায়ের মোহাম্মদ, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-26 10:20:42

দক্ষিণ এশিয়ার উত্তরপূর্বাঞ্চল দৃশ্যত শান্ত থাকলেও সেখানে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। অশান্তির সূত্রপাত হয়েছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মণিপুর রাজ্যে। এখনও সেখানে সহিংসতা এবং রক্তপাত বিরাজমান। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, উত্তরপূর্বাঞ্চলের সহিংস-অস্থিরতার প্রতিক্রিয়া আঞ্চলিক শান্তুি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।

উত্তরপূর্ব ভারতে সাম্প্রতিক সহিংসতার মূলে রয়েছে উপজাতিগত দ্বন্দ্ব। যখন ভারতের মণিপুর রাজ্যের হাই কোর্ট মেইতেইদের তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে রাজ্য সরকারকে বিবেচনা করার নির্দেশ দিয়েছিল, তখনই অন্যান্য উপজাতি সংগঠনগুলো তার বিরোধিতায় পথে নামে। আর সেই ঘটনা থেকেই সশস্ত্র সংঘাতের সূচনা হয় সেখানে।

মণিপুরের আদি বাসিন্দা হিন্দু ধর্মাবলম্বী মেইতেই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কুকি, জ়ো-সহ কয়েকটি তফসিলি জনজাতি সম্প্রদায়ের (যাদের অধিকাংশই খ্রিস্টান) সংঘর্ষ ঠেকাতে গত ৬ মে মণিপুরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। নামানো হয় সেনা এবং আসাম রাইফেলস বাহিনিকে। সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদারকির ভার দেওয়া হয় সিআরপিএফের প্রাক্তন প্রধান কুলদীপ সিংহকে। তাঁর অধীনে এডিজিপি (ইন্টেলিজেন্স) আশুতোষ সিংহকে সমগ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপারেশনাল কমান্ডার-এর দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ১ মাস কেটে গেলেও এবং খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার পরেও সেখানে হিংসা থামেনি এবং থেমে থেমে সহিংসতা ও সশস্ত্র তৎপরতা চলছে।

কুকি উপজাতির অধিকাংশই খ্রিস্টান হওয়ায় এবং তাদের অনেক সদস্য মিয়ানমার ও বাংলাদেশে বসবাস করায় ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও জাতিগত কারণে নিবিড়ভাবে আবদ্ধ। ফলে মনিপুরের ঘটনার প্রভাব ত্রিদেশীয় কুকি উপজাতি সদস্যদের প্রভাবিত করার সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনিভাবে কুকি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের উত্থানেরও আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে। যার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী বান্দরবানে কুকিদের সশস্ত্র তৎপরতার ঘটনায়। পরবর্তীতে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও রিক্রুটমেন্ট সম্পর্কেও তথ্য পাওয়া যায়, যা নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

শান্তিচুক্তির দুই যুগের বেশি সময়কালে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের ধারায় পাহাড়ি-উপজাতি এবং পাহাড়ি-বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর জীবনমানের অভূতপূর্ব অগ্রগতির পটভূমিতে নতুন করে সশস্ত্র তৎপরতার ঘটনা কিসের আলামত, তা খতিয়ে দেখা দরকার। বিশেষ করে, দুই যুগ আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাহানির অন্ধকার অধ্যায়ের অবসান হয়ে এসেছিল শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের নতুন ভোর। তারপর আলোকোজ্জ্বল হয়েছে পশ্চাৎপদ পার্বত্যাঞ্চল। নবজীবনের স্বাদ পেয়েছে পাহাড়ে বসবাসকারী উপজাতি ও বাঙালি জনগোষ্ঠী। এখন যদি আবার সেখানে রক্তপাতের উত্থান ঘটে, তাহলে পার্বত্যাঞ্চলের যাবতীয় অর্জন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

ফলে অকস্মাৎ বান্দরবানের গহীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাদের স্বার্থে, কাদের মদদে শুরু হলো সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নাশকতা, তা অনুসন্ধান করে মূলোৎপাটন করা জরুরি। অভিজ্ঞরা বলেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম হলো লাভজনক সন্ত্রাসবাদের ‘দোকান’। সেখানে সন্ত্রাসের নতুন সংজ্ঞার নাম 'পাহাড় দখল'। তারপর আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক মাফিয়া গোষ্ঠীর মদতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আফিম ও গাঁজার চাষ। বিশ্বের অন্যতম প্রধান হেরোইন রাজধানী, অস্ত্রের বাজার ও মানব পাচারের ঘাঁটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ, ভারত ও মায়ানমারের সীমান্তরেখা।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিক তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের অপর পার্শ্বের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো মাদক তৈরির ও অস্ত্রের কারখানা গড়ে উঠছে। মানুষ ফসলের চাষবাস বন্ধ করে আফিম চাষ করছেন। ভারত-মায়ানমার-বাংলাদেশ (পার্বত্য চট্টগ্রাম) সীমান্ত জুড়ে মাদক তৈরি সংগঠিত ‘শিল্প’, যা কুকিদের ব্যবহার করে তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মায়ানমার ও ভারতের মণিপুর-মিজ়োরাম থেকে কুকিরা নাগাড়ে ঢুকছেন মাদক আর অস্ত্র নিয়ে। আফিম চাষের পাশাপাশি উন্নত আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েও মদত দিচ্ছে, সীমান্তের ও-পারের এজেন্টরা। যার ফলে নিরাপত্তার ক্ষতি হচ্ছে শান্ত পাহাড়ের এবং বিশেষভাবে বান্দরবানের।

বান্দরবানের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের প্রভাব পড়েছে পার্শ্ববর্তী রাঙামাটিতেও। রাঙামাটিতে অস্ত্রধারী পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে টোকেন না নিয়ে গাড়ি চালানোয় যাত্রীবাহী অটোরিকশায় আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। শুক্রবার (৯ জুন) রাত সাড়ে আটটার সময় রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের দেপ্পোছড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটিয়েছে সন্ত্রাসীরা। ঘটনার সময় দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলিও ছুড়েছে বলে জানিয়েছেন ঘটনার শিকার অটোরিকশা চালক বানেশ্বর ও যাত্রী হারুন। এসব অপতৎপরতার শিকড় উচ্ছেদ না করা হলে তা সন্ত্রাসের বিষবৃক্ষে পরিণত হতে পারে।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উত্তরপূর্বের সহিংস-অস্থিরতার ঘটনা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। এসব ঘটনার জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিপদ সম্পর্কেও সতর্ক থাকা প্রয়োজন। আঞ্চলিক শান্তুি, স্থিতি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ সশস্ত্র সন্ত্রাসী, অস্ত্র ব্যবসায়ী ও মাদক মাফিয়ারা যাতে জাতীয় নিরাপত্তা, সামাজিক শান্তি বিনষ্ট করতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় সামরিক পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলাও অপরিহার্য। তাহলে সশস্ত্র সন্ত্রাসী, অস্ত্র ব্যবসায়ী ও মাদক মাফিয়া চক্রের অবৈধ ও অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ বন্ধ হতে পারে। প্রয়োজনে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরিসরে সন্ত্রাসবাদ, অস্ত্র ব্যবসা, মাদক চোরাচালান ও মানব পাচারের বিরুদ্ধে যে ঐকমত্য রয়েছে, তা আরও জোরদার করার পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

শান্তিচুক্তির ফলে বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলে যে স্থিতিশীলতা, সম্প্রীতি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে, তা সামরিক-বেসামরিক-নাগরিক উদ্যোগের মাধ্যমে সুনিশ্চিত করতে হবে। সন্ত্রাসীদের ভীতি থেকে মানুষ ও জনপদের সকল ইতিবাচক কর্মকাণ্ডকে সুরক্ষা দিতে হবে। এবং উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশ নামে ২৩ (ক) নতুন অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত করা ছাড়াও রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থ নেওয়ার যে কথা বলা হয়েছে, সন্ত্রাস ও রক্তপাতের মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। তা করতে হবে চলমান শান্তি, সম্প্রীতি, উন্নয়ন ও নিরাপত্তার চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, এমনটিই মনে করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সামাজিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিগণ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর