‘আসে বসন্ত ফুল বনে সাজে বনভূমি সুন্দরী, চরণে পায়লা রুমুঝুমু মধুপ উঠিছে গুঞ্জরী’ পুষ্পিত সৌরভে এভাবেই ঋতুরাজ বসন্ত তার আগমনের বার্তা নিয়ে প্রকৃতির দরজায় কড়া নাড়ছে। শীতের আমেজ কমে প্রকৃতি সেজেছে রঙিন সজ্জায়। শীতের রুক্ষতা কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। বসন্তদূত কোকিলের অবিরাম কুহু ডাক সবার কানে কানে বলে যায় বসন্ত এসে গেছে।
বসন্তের আগমনের সাথে সাথে দেশসেরা রাজশাহী কলেজ তার বার্ষিক বসন্ত বরণ উৎসবের জন্য সজ্জিত হচ্ছে। কলেজের শিক্ষার্থীরা রং তুলির আঁচড়ে তাদের ক্যাম্পাসকে বর্ণিল করে তুলছেন, যা বসন্তের আগমনকে স্বাগত জানায়।
রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা রাজশাহী কলেজে লেগেছে বসন্তের হাওয়া। কলেজের প্রশাসন ভবনের সামনে রং-তুলি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। কেউ প্লাস্টিকের পাত্রে রং তৈরি করছেন। আবার কেউ সেই রং দিয়ে রাঙিয়ে তুলছেন ক্যাম্পাসের আঙ্গিনা। ক্যাম্পাসের মাটিতে ছোঁয়া লাগছে হরেক রকমের রং-তুলির। লাল, নীল, সবুজ, হলুদসহ নানা রঙের তুলিতে তৈরি হচ্ছে দেয়ালচিত্র, রঙিন হচ্ছে ক্যানভাস। ১৪ ফেব্রুয়ারি বসন্ত বরণকে কেন্দ্র করে অঙ্কন করা হচ্ছে এই প্রতিচ্ছবি। রং-তুলির আঁচড়ের মাধ্যমে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে বসন্ত বরণের আমেজ।
শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে রংধনুর সাত রং, ফুলের ডিজাইন, এবং বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মোটিফ আঁকছেন। এই উৎসবের প্রস্তুতি শুধু ক্যাম্পাসকে সজীব করে তোলে না, বরং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতা এবং ঐক্যের এক অনন্য বন্ধন সৃষ্টি করে।
সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ক্যাম্পাসের আনাচে-কানাচে চলছে আঁকিবুকি। যেখানে সবার নিয়মিত আড্ডার রং ছড়াতো সেখানে রঙিন এখন আলপনার রঙে। রবীন্দ্র নজরুল চত্বর, হাজী মোহাম্মদ মহসিন ভবনের সামনের রাস্তা, শহীদ কামরুজ্জামান ভবনের সামনের রাস্তা থেকে প্রশাসনিক ভবনের সামনের অংশ সবটাতে দৃষ্টি কাড়ছে রঙিন আলপনা। আড্ডা, গল্প, খেলাধুলা, হৈ-হুল্লোড়, গিটারের টুংটাং শব্দে ক্যাম্পাসে রোমাঞ্চকর পরিবেশ যেন রোজকার চিত্র। আলপনার আঁচড়ে আজ সেই চিত্রে ব্যতিক্রম ঘটেছে। আড্ডা-গানের আসরের পাশাপাশি চিত্রকল্পে চলছে উৎসবের প্রস্তুতি।
সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজশাহী কলেজ ক্যাম্পাসের প্রশাসন ভবনের সামনে গিয়ে দেখা যায়, পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে ক্যাম্পাস চত্ত্বর। বসন্ত বরণে বিভিন্ন আলপনা আঁকছেন অনেকে। তাদের মধ্যে উৎসব উৎসব ভাব। অনেকেই সেখানে আঁকার ফাঁকে ফাঁকে সেলফি তুলতে ব্যস্ত।
রাজশাহী কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আব্দুল খালেকের নির্দেশনায় বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইকবাল হোসেনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে আলপনায় অংশ নিয়েছে কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীসহ অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
তারা বলছেন, বসন্ত বরণ আমাদের কলেজের একটি ঐতিহ্য, এবং প্রতি বছর আমরা এই উৎসবকে আরও সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী উপায়ে উদযাপন করতে চেষ্টা করি। এই বছর আমরা রং এবং আঁকা দিয়ে আমাদের ক্যাম্পাসকে সজ্জিত করে বসন্তের আনন্দ ছড়াতে চাই। বসন্ত বরণ উৎসবের দিন, কলেজ প্রাঙ্গণে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গান, নৃত্য, এবং কবিতা পাঠের মতো কার্যক্রম আয়োজন করা হয়, যা শিক্ষার্থীদের সাথে সাথে শিক্ষক ও কর্মচারীদেরও একত্রিত করে। এই উৎসবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিল্প ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতি আগ্রহ এবং সম্মান বৃদ্ধি করার লক্ষ্য রাখে। বসন্তের এই উদযাপন কলেজের সম্প্রদায়কে আরও কাছাকাছি আনে।
রাজশাহী কলেজ ক্যাম্পাসের সামনে রং তুলির আঁচড়ে আলপনা আঁকছিলেন বাংলা বিভাগের সম্মান চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহবুব জামান, হামিদা আক্তার রেখা ও আনিকা ইসলামসহ বিভাগের অগ্নিবীণা সংগঠনের শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন রং লেগে তাদের মুখ রঙিন হয়ে গেলেও সেদিকে মন নেই। আলপনায় তুলির আঁচড় দিতেই তারা ব্যস্ত। তারা বলেন, প্রতিবছর আমাদের কলেজে আলপনার উৎসব হয়ে থাকে। এবারও ব্যতিক্রম নয়; রং তুলির আঁচড়ে আলপনা আঁকছি এতে খুব ভালো লাগছে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলপনা আঁকা দেখছিলেন রাজশাহী কলেজ সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফারহানা আক্তার ছন্দা। তিনি বলেন, আমাদের কলেজে প্রতিবছর এভাবেই আলপনা একে বসন্তকে বরণ করা হয়। এত কলেজের শিক্ষার্থীরা ভালো কাজের দিকে উদ্বুদ্ধ হয়। সংস্কৃতি চর্চায় নিজেকে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
আলপনা আঁকার দেখভাল করেছেন বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, বসন্ত মানেই বাংলা বিভাগ। আর আমরা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবো না তা তো হয় না। শিক্ষার্থীরা কঠোর পরিশ্রম দিয়ে সারাদিন আলপনা আঁকছে। আজ যারা আলপনায় হাত বাড়িয়েছে, তারা কেউ পাকা শিল্পী নয়। এটা তাদের ভালোবাসার থেকে, ভালোলাগা থেকে। এই আলপনায় ফুটিয়ে তুলেছে বসন্তের আমেজ, যা দেখে আমি অভিভূত।
রাজশাহী কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহা. আব্দুল খালেক বলেন, সবুজ চাদরে মোড়ানো ক্যাম্পাসটি নিজের মতো করে সাজিয়ে নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তারা সাজগোজসহ নানা শিল্পমুখী কাজে রাঙিয়ে চলছে অনবরত। বসন্তকে বরণ করতে ও ক্যাম্পাসকে রাঙাতে রাঙানো হচ্ছে বিভিন্ন আলপনা। সব চাপিয়ে এই রং তুলির আঁচড়ই যেন দোলা দেয় শিহরণ জাগানিয়া আবহে। এটা খুবই ভালো দিক। চারুকলা নামে কোন বিভাগ না থাকার পরেও শিক্ষার্থীরা এমন কাজে আমাদেরকে আনন্দিত করছে।