রাজধানীর হাজারীবাগ থানার বোরহানপুর এলাকার বাসিন্দা মো. ইদ্রিসের মেয়ে সুমনা খাতুন (১৫)। কাগজে কলমে কিশোরী হলেও সুমনা জীবনের পথে এগিয়ে গেছে বহুদূর। প্রাথমিকের গণ্ডি না পেরোতেই শিক্ষা থেকে ঝড়ে পড়ে। এরই মধ্যে ভালোবেসে বিয়ে করে হাজারীবাগ এলাকার লেগুনা চালক শাওনকে।
দুই বছরের সংসারে সুমনার কোলে আসে সন্তান। ৯ মাস বয়সী ছেলেটিকে রেখে হঠাৎই হারিয়ে গেলো মেয়েটি। শিশুটি হলো মা-হারা।
ওদিকে একই এলাকার নাসিমার মেয়ে খাদিজাও একই পথের পথিক। মাত্র ১২ বছর বয়সে ভালোবেসে বিয়ে করে সবুজ নামের এক তরুণকে। বিয়ে বছর না যেতেই স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় মায়ের কাছে এসে থাকতো। খাদিজাও হারিয়ে গেছে। মায়ের বাসা থেকে বান্ধবী সুমনাকে নিয়ে বের হয়ে গত ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায়। সেই থেকে নিখোঁজ সুমনা ও খাদিজা! এরপর আর তাদের সন্ধান পাচ্ছে না পরিবার।
থানায় সাধারণ ডায়েরি করলেও পুলিশের সহযোগিতা পাচ্ছে না দুটি পরিবার! নানা জায়গায় ধরনা দিয়েও খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে তাদের। পরে এই ঘটনায় সুমনার মা নিলু বাদী হয়ে হাজারীবাগ থানায় মামলা দায়ের করেন। শুরু হয় মামলার ছায়া তদন্ত। তাতে নেমে একটি অপহরণ চক্রের সন্ধান পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)’র রমনা বিভাগ। তাতে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মানব পাচার এক চক্রের তথ্য বেড়িয়ে আসে। যারই শিকার সুমনা ও খাদিজা।
পুলিশ এরই মধ্যে গ্রেফতার করেছে পাচার চক্রের অন্যতম হোতা কবির হোসেনকে। সীমান্ত এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে খুলনার দৌলতপুর থেকে একইভাবে হারিয়ে যাওয়া সীমা আক্তার ও তার ১০ বছর বয়সী ছেলে নবাব শেখকে। তবে সুমনা ও খাদিজার অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য এখনো মেলেনি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে।
রাজধানীর হাজারীবাগে নিখোঁজ দুই কিশোরীর বাসায় গিয়ে দেখা মেলে এক করুণ দৃশ্যের। নিখোঁজ খাদিজার মা নাসিমা বেগম, পেশায় গৃহকর্মী। বাবা আহম্মদ, পেশায় একজন জেলে। পেশাগত কারণেই খাদিজার মা থাকেন ঢাকায়, বাবা নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের এদেরকান্দি গ্রামে। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে খাদিজা চতুর্থ। মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে করে কিছু দিন খুলনার বাগেরহাটে স্বামীর সঙ্গে ছিলেন। পরবর্তীতে পারিবারিক কলহের কারণে স্বামী থেকে দূরে থাকছেন।
হাজারীবাগের মনেশ্বর লেনের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ফ্লোরে পাতলা একটি তোশক বিছানো। তাতে শুয়ে আছেন এক বৃদ্ধা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাক দিতেই চোখ মেলে তাকালেন। প্রতিবেদকের পরিচয়ে জেনে নিজেকে টেনে তুলে বসলেন। জানা গেলো তার নাম ফিরোজা বেগম। নাতনি খাদিজা নিখোঁজের খবর পেয়ে ঢাকায় ছুটে এসেছেন। কাজে থাকায় অপেক্ষা করেও খাদিজার মায়ের দেখা মিললো না।
ফিরোজা বলেন, আমার মেয়ের পাঁচটা সন্তান। স্বামীর আয়ে সংসার চলছিল না। তাই মেয়ে নাসিমা ঢাকায় এসে গৃহকর্মীর কাজ করছেন। নিখোঁজ হওয়ার কয়েক দিন আগে আড়াইহাজার থেকে মায়ের কাছে আসে খাদিজা। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার কথা বলে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি।
তিনি আরও বলেন, খাদিজার বাবা মেঘনা নদীতে মাছ ধরে। মেয়ে বাসা বাড়িতে কাজ করে ছেলে মেয়েদের দু মুঠো ভাত দিচ্ছে। এখন আমরা কার কাছে যাব। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।
খাদিজার মায়ের সঙ্গে থাকেন নাতনি পলি। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘খালামনি (খাদিজা) মাঝে মাঝে ঢাকায় এসে থাকেন, আবার গ্রামে চলে যান। কয়েক দিন আগে ঢাকায় আসেন। তাকে প্রায়ই দেখতাম ফেসবুক ব্যবহার করতে। কিন্তু কারো সঙ্গে কথা বলতে দেখিনি। কীভাবে কি হলো বুঝলাম না।’
একই দিনে নিখোঁজ হওয়া সুমনা স্বামী সন্তান নিয়ে হাজারীবাগ এলাকায় মায়ের সঙ্গে থাকতেন। জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ হাজারীবাগের মাহাদীনগর এলাকায় আলাদা বাসা নেন। পরবর্তীতে ২৩ জানুয়ারি ৯ মাস বয়সী ছেলে আবিরকে নিয়ে মায়ের বাসায় আসে। সুমনা আসার একটু পর একই বাসায় আসে তার বান্ধবী খাদিজা। কিছু সময় অবস্থান করার পর বান্ধবী খাদিজাকে নিয়ে বের হয়ে যায় সুমনা।
৯ মাস বয়সী শিশুটি মায়ের জন্য কান্নাকাটি করে উল্লেখ করে সুমনার মা নীলু বলেন, মেয়েটা জীবনের শুরুতেই একটা ভুল করে বসে। তারপরও আমরা মেনে নিয়েছি। স্বামীকে নিয়ে আমাদের কাছে থাকত। হঠাৎ ১৫ তারিখ অন্যত্র বাসা ভাড়া নিলো। এরপর ২৩ তারিখ বাসায় এসে বাচ্চাটা রেখে বের হয়ে আর এলো না। নাতিটা (সুমনার ছেলে) মায়ের জন্য কান্নাকাটি করে। এতো ছোট বাচ্চা মা ছাড়া কি রাখা যায়? কি করবো কার কাছে যাবো কিছুই বুঝতে পারছি না।
তিনি বলেন, নিখোঁজের পাঁচদিন পর ২৮ জানুয়ারি রাত একটার দিকে বড় ভাই রাজুর মোবাইলের ইমো নাম্বারে বাঁচার আকুতি জানিয়ে ফোন করেছিলো সুমনা। ঘুমন্ত অবস্থায় বিষয়টা বোঝার আগেই পাশের লোকজন তার ফোন কেড়ে নেয়। পরবর্তীতে ফোন করা হলে এক ব্যক্তি জানায়, সুমনাকে ভারতের কেরালায় পাচারকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। মেয়েকে ফিরে পেতে পরিবারের সদস্যদের ভারতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ফোনটি কেটে দেন। পরে আমরা শুনেছি একই সময়ে খাদিজাও নাকি তার মাকে ফোন করেছিল। এরপর আর কোনো সন্ধান পাচ্ছি না।
নিখোঁজ সুমনা দিনমজুর বাবা ইদ্রিস ও মা নীলুর সাত সন্তানের মধ্যে তৃতীয়। তাদের গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর থানার শুক্তাবাদ এলাকায়। পরিবারের সঙ্গে হাজারীবাগ এলাকায় থাকত। স্বামী শাওন বেড়িবাঁধ এলাকায় মোহাম্মদপুর-সেকশন রুটের লেগুনা চালান।
মা নীলু আক্ষেপ করে বলেন, মানুষের বাসায় কাজ করে অনেক শখ করে মেয়েকে একটা টাচ (স্মার্ট) মোবাইল কিনে দিয়েছিলাম। সেই মোবাইলই কাল হলো মেয়েটার জন্য।
কথা বলা শেষে নিখোঁজ দুই কিশোরীর পরিবারের কাছে তাদের ছবি চেয়েও পাওয়া যায় নি। পাচারের পরিসংখ্যানের খাতায় আরও দুটি বাড়তি সংখ্যা হয়ে গেলো তারা!
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি)’র রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ ফজলে এলাহী বার্তা২৪.কম-কে বলেন, চাকরির নামে মানবপাচার চক্রের এক সদস্যকে আমরা দু’জন ভিক্টিমসহ গ্রেফতার করেছি। আমাদের তদন্ত কাজ চলছে। চক্রের মূলহোতা আনারুলসহ পাঁচ থেকে ছয় জনের নাম পেয়েছি। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
এদিকে ফেসবুক, টিকটকসহ সামাজিক মাধ্যমে ফাঁদে ফেলে মানবপাচার প্রায়ই ঘটছে।