রাজধানীর গুলিস্থানের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী মারুফ হোসাইন। কাজের কারণেই এই এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত করতে হয় তাকে। গত বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) বেলা ৩ টায় অফিস শেষ করে প্রধান সড়ক ধরে হন্তদন্ত হয়ে বাসার উদ্দেশ্যে ছুটে যাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ একটি রিকশা ধাক্কা দেয় তাকে। এক পর্যায়ে রিকশা চালকের সঙ্গে কথা কাটাকাটি থেকে ঘটনা গড়ায় হাতাহাতি পর্যন্ত।
রিকশা চালকের ভাষ্য, ফুটপাত দিয়ে না হেঁটে রাস্তা ধরে হাঁটছিলেন মারুফ হোসাইন। যার ফলে রিকশার সঙ্গে ধাক্কা লাগে। ফুটপাতে হাঁটাচলার জন্য কোনো জায়গা নেই এমন অভিযোগ করে মারুফ হোসাইন বলেন, হাঁটাচলার জন্য ফুটপাতের কোথাও এখন আর জায়গা নেই। পথচারীদের জন্য ফুটপাত এখন অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফুটপাতের সব জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে দোকানপাট। ফলে বাধ্য হয়েই গন্তব্যে যেতে প্রধান সড়কে নামতে হয়েছে তাকে।
মারুফের কথার সুত্র ধরে গুলিস্তান এলাকায় সরেজমিনে নামে বার্তা ২৪. কম। সরজমিনে দেখা যায়, গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু করে পুরো গুলিস্তানজুড়েই পথচারীদের হাঁটার জায়গা দখল করে ব্যবসা করছেন ছিন্নমূল ব্যবসায়ীরা। এতে করে গুলিস্তানে সারাক্ষণ লেগে থাকছে যানজট। পদচারীদের নিরাপদে হাঁটার জন্য কোনও জায়গা নেই বললেই চলে। রাস্তার দুপাশে খুচরো কাপড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে চা বিক্রেতাসহ সবাই ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করছেন।
ফুটপাতের এ অবস্থার জন্য সিটি করপোরেশনকে দুষছেন পদচারীরা। তারা বলেন, সিটি করপোরেশনের গাফিলতির কারণেই খুচরো ব্যবসায়ীরা ফুটপাত দখল করে বসে আছে। তারা আরও বলেন, মেয়র চাইলে অবশ্যই ফুটপাত দখলমুক্ত করা সম্ভব।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফুটপাত থেকে দখল উচ্ছেদ করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সংস্থাটি। ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে বিশেষভাবে রেড, ইয়েলো এবং গ্রিন জোন নির্ধারণের কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে সিটি করপোরেশন আটটি জায়গাকে লাল চিহ্নিত করেছে, যেখানে ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করছে ছিন্নমূল ব্যবসায়ীরা। আটটি জায়গা থেকে ব্যবসায়ীদের সরিয়ে ফুটপাত দখল মুক্ত করা হবে বলেও জানিয়েছে সিটি করপোরেশন।
মোহাম্মদ কাউসার মাহমুদ নামে একজন পথচারী বলেন, আমি যাত্রাবাড়ি থাকি। প্রতিদিন আমি গুলিস্তান দিয়ে যাতায়াত করি। গুলিস্তানের হকাররা ফুটপাত দখল করে রাস্তার অর্ধেক পর্যন্ত দোকান বসানোর কারণে এই এলাকায় প্রতিনিয়ত যানজটের সৃষ্টি হয়। এই যানজটের কারণে, একটি গাড়ি পার হতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায়। ফুটপাতে জায়গা না থাকায় আমাদের চলাচল করতে অসুবিধা হয়। ফলে, আমরা ঝুঁকি নিয়ে মূল সড়কের উপর দিয়ে চলাচল করি। ফুটপাত দিয়ে চলাচলের সময় ব্যবসায়ীরা আমাদের সাথে বিভিন্ন ধরনের খারাপ আচরণ করে।
আহসান হাবিব নামের আরেক পথচারী বলেন, গুলিস্তান এমন একটি জায়গা যেখানে কোনও নিয়মকানুন নেই। কেউ কোনও ধরনের নিয়ম মানে না। গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট থেকে বাসে উঠলে গুলিস্তান আহাদ পুলিশ বক্স পর্যন্ত যেতে সময় লাগে মাত্র দুই থেকে তিন মিনিট। কিন্তু, যানজটের কারণে সেখানে যেতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগে। আর ফুটপাত দিয়ে আহাদ পুলিশ বক্সে হেটে যেতে চাইলে ১০ মিনিটের জায়গায় প্রায় আধা ঘণ্টা লাগে। এর কারণ হলো, ফুটপাত দখল।
সম্প্রতি ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এর উদ্যোগে ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে আয়োজিত "পুরোনো ঢাকার ব্যবসা-বাণিজ্যে যানজটের প্রভাব ও উত্তরণের উপায় চিহ্নিতকরণ" শীর্ষক অংশীজনদের এক সভায় ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, এই ফুটপাতের ভেতরে মনে হয় যেন সবচেয়ে বেশি ব্যবসায়ী থাকে। প্রতিনিয়ত আমাদের উচ্ছেদ অভিযান চলমান রয়েছে। ফুটপাত থেকে ব্যবসায়ীদের সরানো হলে কিছুদিনপর তারা আবার বসে। আমাদের মেয়র মহোদয় ইতিমধ্যে ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে বিশেষভাবে রেড, ইউলো এবং গ্রিন জোনের কাজ করে যাচ্ছেন। এটি বাস্তবায়ন হলে সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে বলে মনে করেন তিনি।
একই দিন ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, হকার উঠানো যত সহজ মনে করা হয়, তত সহজ নয়। আমরা উচ্ছেদ অভিযান করার তিন-চারদিন পর তারা আবার বসে পড়ে। আমরা কিছু কৌশল নিয়ে ব্যবস্থাপনা করে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা লাল, হলুদ এবং সবুজ চিহ্নিত করেছি। আমরা কিছু জায়গায় হলুদ চিহ্নিত করে হকারদেরকে বলে দিয়েছি তারা যাতে ব্যবসা করে। হলুদ চিহ্নিত জায়গায় ব্যবসা করতে ট্রেড লাইসেন্স লাগবে না এবং কোনও সংস্থাকে কোনও টাকাও দিতে হবে না। কিন্তু, লাল চিহ্নিত জায়গায় তারা ব্যবসা করতে পারবে না।
মেয়র আরও বলেন, আমরা এপর্যন্ত আটটি জায়গাকে লাল চিহ্নিত করেছি। সেগুলো হলো- লক্ষ্মীবাজার থেকে সোহরাওয়ার্দী কলেজ, গুলিস্তান আহাদ পুলিশ বক্স থেকে শুরু করে জিপিও মোড়, বঙ্গভবন থেকে জিপিও মোড়, সুন্দরবন মার্কেট থেকে ফুলবাড়িয়া রোড়, গুলিস্তান ফোয়ারা থেকে গোলাপশাহ মাজারসহ আরও অন্যান্য জায়গাকে আমরা লাল চিহ্নিত করেছি। এসমস্ত জায়গায় কোনও হকারকে ব্যবসা করতে দেয়া হবে না। এরকম ব্যাপক কার্যক্রম আমরা হাতে নিয়েছি এবং এগুলো এবছর থেকে দৃশ্যমান হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি এবং নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বার্তা ২৪ কে বলেন, গুলিস্তান এবং এর আশেপাশের এলাকায় সিটি করপোরেশন অনেকবার অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। হকার উচ্ছেদে সিটি করপোরেশনের চালানো অভিযান তেমন কার্যকর এবং টেকসই হয়নি। এটার মূল কারণ হচ্ছে একটি চক্র আছে যারা হকারদের বসায়। এদের মধ্যে রাজনৈতিক চক্র আছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও একটা চক্র আছে। সিটি করপোরেশন তাদের অভিযান চালানোর পরে বিভিন্ন চক্র আবারও হকারদেরকে ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করতে সাহায্য করে।
তিনি আরও বলেন, সরকার এবং সিটি করপোরেশনের উচিত কারা এই হকারদেরকে সাহায্য করে সেটা খুঁজে বের করে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। সিটি করপোরেশনের একটা ডাটাবেইজ তৈরি করা উচিত যার মাধ্যমে কোথায় কি পরিমাণ হকার বসে সেটা জানতে পারবে। হকারদেরকে পুনর্বাসন কিংবা সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে নিয়ে আসা উচিত। এগুলো সিটি করপোরেশন না করলে উচ্ছেদ অভিযান কখনোই টেকসই হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।