১৪৩০ বঙ্গাব্দের সর্বশেষ সূর্যটা ওঠে আবার ডুবেও গেছে। দিনটাও শেষ, প্রতিদিনের মত রাত ১২টায়। ১৪ এপ্রিল ভোরে যে সূর্য ওঠবে ওটা নতুন বছরের। শনিবার দিন শেষে মাঝরাতে যে দিন শুরু ওটা নতুন বছরের; ১৪৩১ বঙ্গাব্দের।
নতুনে আমাদের চাওয়া কী—এনিয়ে ভাবছি না; পুরনোয় আমাদের হতাশা কী—এনিয়েও ভাবছি না। স্বাভাবিক জীবনের স্বাভাবিক দিন-রাত, ঘূর্ণাবর্ত। আমাদের কী চাওয়ার সে আলোচ্য নয়, আলোচ্য হলো আমাদের বাঙালিয়ানা আর উদযাপন। সকলেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করুক। সর্বজনীন হোক সে উৎসব, সে উদযাপন। এখানে কূপমুণ্ডক আছে, থাকবে; থাকুক। তবু তাদের চপেটাঘাত করে বাঙালির নববর্ষ আপন আলোয় ভাস্বর হোক, হবে।
প্রতিবছরের মতো এবারও পহেলা বৈশাখে লক্ষ লোক রাস্তায় নামবে, এটা তাদের কাছে উৎসব। এই বেরিয়ে আসা মানুষদের সবার মধ্যে বাঙালিয়ানা খুঁজে নেওয়া অর্থহীন। এক দিনে, এক উৎসবে, এক আলিঙ্গনে শুদ্ধতা সম্ভব না—এর জন্যে সময়ের দরকার। গত কয়েক বছরে মানুষ এভাবে রাস্তায় উৎসব উৎসাহে বেরিয়ে আসছে বলে কূপমুণ্ডকেরা গর্ত লুকাচ্ছে, উঁকি দিচ্ছে আবারও আপন আশ্রয় ভেবে খুঁজে নিয়েছে সে গর্ত। এটা আমাদের আশাবাদের জায়গা। এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
গ্রামাঞ্চলেও দেখেছি পহেলা বৈশাখের দিনে আজকাল মানুষজন নতুন জামা কেনে। ঈদ-পূজার বাইরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে ক্রমশ এটাকেও উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মানসিকতা দারুণ এক আনন্দের। এভাবেই বদলে যাবে, আগে উৎসাহে উৎসব করে, পরে এর ভেতরের মধু খুঁজে নিয়ে।
এবার পহেলা বৈশাখের ছুটির আগে ছিল দীর্ঘ ঈদের ছুটি। ঈদ, সাপ্তাহিক ছুটি, পহেলা বৈশাখের ছুটি মিলিয়ে টানা পাঁচদিনের ছুটি উদযাপন করছে মানুষ। এই ছুটি জরা-খরা, অপ্রাপ্তি ভেঙে নূতনের পথে আবাহনের। ডিএল রায়ের ভাষায়—❛নূতন আলোকে নূতন পুলকে/ দাও গো ভাসায়ে ভূলোকে-দ্যুলোকে/ নূতন হাসিতে বাসনারাশিতে/ জীবন মরণ ভরিয়ে দাও...❜ এই আবাহন, এই আহ্বান কাঙ্ক্ষিত, অতি-কাঙ্ক্ষিত মানুষের, অন্তর্গতও বটে। এরবাইরে বহিঃস্থ রূপ অনেকটাই মুখোশের দৃশ্যায়ন।
এই সময়ের বাঙালি-মানস অনেকটাই বিভক্ত। বাঙালি জাতিসত্তার একজন হয়েও অনেকেই নিজেদের শেকড় অস্বীকার করে। ধার করা কিংবা আমদানি করা সংস্কৃতিকে নিজেদের সংস্কৃতি প্রকাশে মরিয়া একদল। উচ্চকণ্ঠ যারা তারা অন্যের উৎসব সহ্য করতে পারে না। এখানে বারবার আক্রমণের শিকার বাঙালির সংস্কৃতি, বাঙালির উৎসব। আছে ধর্মীয় ব্যাখ্যা। পহেলা বৈশাখের উদযাপনকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বলে উচ্চকণ্ঠ যে শ্রেণির লোকজন তাদের অনেকেই আবার ধর্মীয় সংস্কৃতিকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করায় যখন তখন। কেবল পহেলা বৈশাখ নয়, একদল লোক দেশে এখন দাঁড়িয়ে গেছে যারা ইসলাম ধর্মের পবিত্র শবে বরাত ও ২৭ রমজানের শবে কদর পালন নিয়েও প্রশ্ন তোলে। প্রশ্ন তোলে গুরুজনদের পা ছুঁয়ে করা কদমবুসিকেও। নামাজ শেষে করা মোনাজাতও অনেকের কাছে অশুদ্ধ। কাপড় কোথা পর্যন্ত পরা হবে এনিয়েও আছে বিবিধ বিতর্ক। এই বিতর্ক, বিভক্তির যতটা না প্রাসঙ্গিক কিংবা যৌক্তিক, তারচেয়ে বেশি গোষ্ঠীবদ্ধ প্রচারণা।
ধর্মও যেখানে প্রশ্নের মুখে তাদের কাছে, সেখানে বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ নিয়ে প্রশ্নও অস্বাভাবিক নয়। অথচ ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ একটি ❛ধর্মনিরপেক্ষ নববর্ষ❜। কারণ নানা আলোচনা-গবেষণা শেষে বাংলাদেশ নির্ধারণ করেছে কবে হবে বাংলা নববর্ষ। এখানে তাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে কিছুটা পার্থক্য। বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ যখন ১৪ এপ্রিল, তখন ভারতে সেটা ১৪ অথবা ১৫ এপ্রিল। বাংলাদেশ বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং রাষ্ট্রীয় বিশেষ দিনগুলোকে বঙ্গাব্দ-খ্রিস্টাব্দের একই তারিখে রাখতে সংস্কারকে গ্রহণ করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সংস্কারকে গ্রহণ করেনি, ফলে তাদের কাছে নববর্ষ এখনো ধর্মীয় দিনপঞ্জিকা। হতে পারে তাদের ইতিহাসের সঙ্গে ১৬ ডিসেম্বর, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চের যোগ নেই বলে তাগিদও নেই।
কয়েক বছর আগে ডয়চে ভেলেতে প্রকাশিত একটা সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদনে বাংলা একাডেমির সাবেক পরিচালক ফরহাদ খান ❛কেন ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশ পহেলা বৈশাখ হিসাবে বেছে নিয়েছিল❜ তার একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন—❛অবিভক্ত বঙ্গদেশে নবদ্বীপের পণ্ডিত স্মার্ত রঘুনন্দন বাংলা পঞ্জিকা সংস্করণ করেন। এরপর ১৮৬৯ সালে আবারও সংস্করণ হয়। পরে সেটা মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়। এরপর ১৮৯০ সালে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে পঞ্জিকার প্রকাশ চলতে থাকে। ১৯৫২ সালে মেঘনাদ সাহাকে ভারত সরকার পঞ্জিকা সংস্কারের দায়িত্ব দেন। তিনিই শকাব্দ সংস্কার করেন। সেই শকাব্দ অনুযায়ী পয়লা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল। মেঘনাদ সাহার এই সংস্কার বাংলাদেশেও ব্যাপক নাড়া দিয়েছিল। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি ড. শহীদুল্লাকে সভাপতি করে পঞ্জিকা সংস্কার শুরু করে। আগে ৩০, ৩১, ৩২ দিন ছিল। তারপর ঠিক হয়, প্রথম ৫ মাস ৩১ দিনের, বাকি ৭ মাস ৩০ দিনের হবে। এরপর ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে আবারো পঞ্জিকা সংস্কার করা হয়। সেই পঞ্জিকা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। এতে বৈশাখ থেকে ভাদ্র হলো ৩১ দিনে, আশ্বিন থেকে চৈত্র হলো ৩০ দিনে আর খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারের লিপ ইয়ারে ফাল্গুন মাস ৩১ দিনের হবে। অর্থাৎ যে বছর খ্রিষ্টীয় সনে লিপইয়ার, সে বছর বাংলা সনেও লিপইয়ার। এ সংস্কারের ব্যাপারটি যখন আনা হয়, তখন আমাদের গৌরবময় মাস, আমাদের শোকের মাস, আমাদের বিজয়ের মাস, ১৯৭১ সালকে মনে রাখা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে আমাদের যেমন ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ, ২১ ফেব্রুয়ারির যে প্রতিসঙ্গী খ্রিষ্টীয় সবের দিনগুলো, সেগুলোকে এক রাখার জন্যই বাংলা একাডেমি এই সংস্কারটা করে। এতে এখন যেটা দাঁড়িয়েছে, সরকারি পঞ্জিকা অনুসারে ২১ ফেব্রুয়ারি হলো ৯ ফাল্গুন, ২৬ মার্চ হলো ১২ চৈত্র এবং ১৬ ডিসেম্বর হলো ২ পৌষ। এর কোনোদিন এর হেরফের হবে না।❜ [ডয়চে ভেলে, ১৬ এপ্রিল ২০১৮]
বাংলা বর্ষপঞ্জিকা নিয়ে বাংলাদেশের যে সংস্কার সেটাকে দেশের ইতিহাসকে উপজীব্য করে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ সরকারি নথিতে বাংলায় তারিখ লেখা শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই নিয়ম জোরদার হয়। ১৯৮৭ সাল থেকে এই নিয়ম বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে শহীদুল্লাহ কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করে বাংলা দিনপঞ্জিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হলেও অধিবর্ষ গণনার ক্ষেত্রের জটিলতা দেখা দেয়। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হারুন-উর-রশিদকে প্রধান করে পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, ভাষা, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এই কমিটি মেঘনাদ সাহা ও শহীদুল্লাহ কমিটির মূল সুপারিশের নিরিখে ২০টি সুপারিশ পেশ করে। তারপরেও জাতীয় দিবসগুলোয় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ও বাংলা বর্ষপঞ্জি মূলানুগ হয়নি। ফলে ২০১৫ সালে বাংলা বর্ষপঞ্জির অসামঞ্জস্য দূর করে পুরোপুরি বিজ্ঞানভিত্তিক এবং জাতীয় দিবসগুলোকে মূলানুগ করতে এবার তৃতীয়বার সংস্কার কমিটি করা হয়। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানকে সভাপতি করে গঠিত ওই কমিটিতে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক অজয় রায়, পদার্থবিজ্ঞানী জামিল চৌধুরী, অধ্যাপক আলী আসগর, একাডেমির পরিচালক অপরেশ কুমার ব্যানার্জি প্রমুখ। এই কমিটির সংস্কারকে ১৪২৬ বাংলা থেকে বাংলাদেশ গ্রহণ করেছে।
২০১৯ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বাংলা বর্ষপঞ্জি নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ১৯৯৫ সালের সংস্কার অনুযায়ী বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র—বছরের প্রথম এই পাঁচ মাস ৩১ দিন গণনা করা হতো। কিন্তু ১৪২৬ বঙ্গাব্দ থেকে ফাল্গুন মাস ছাড়া অন্য পাঁচ মাস ৩০ দিনে পালন শুরু হয়েছে। ফাল্গুন মাস হচ্ছে ২৯ দিনের, কেবল লিপইয়ারের বছর ফাল্গুন ৩০ দিনের মাস হবে। সবশেষ এই সংস্কারের কারণ সম্পর্কে বাংলা একাডেমির গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেছিলেন, ❛২১ ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চের মত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবস সমূহ বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী যে দিনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই দিনে পালন করা হবে।❜ অর্থাৎ ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর এবং ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা বর্ষপঞ্জিকায় তখন যে দিন ছিল আজীবন বাংলাদেশ সেই একই তারিখে এখন থেকে পালন করে যাবে।
বাংলা বর্ষপঞ্জিকা সংস্কার এবং বাংলা নববর্ষের এই তারিখ নির্ধারণ এবং উদযাপনের সঙ্গে যারা সংকীর্ণ দৃষ্টির প্রচারণায় বিভাজনের চেষ্টা চালায় তারা যে ভুল এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ তাই ধর্মনিরপেক্ষ নববর্ষ। এটা গৌরব আর ইতিহাস ঠিক যে দিনে ঘটেছিল সে দিনকেই মহিমান্বিত করতে।
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা বর্ষপঞ্জিকার ওই সময় যে তারিখে ঘটেছিল আজীবন বাংলাদেশ সে একই তারিখ পাচ্ছে নতুন সংস্কারে। একইভাবে ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চসহ সকল জাতীয় দিবস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম-মৃত্যুর তারিখও দুই ক্যালেন্ডারে হয়েছে মূলানুগ।
❛❛রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি/ আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ/ মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক।❜❜
শুভ নববর্ষ ১৪৩১!