রাজধানীর পীরেরবাগের বাসিন্দা শানিনুর প্রতিদিন ৮টা-৫টা কাজ করে মাসে ১২ হাজার টাকা ঘরে আনেন। স্বামীও কাজ করেন। কিন্তু দুই জনের আয়েও চলেনা পাঁচজনের পরিবার। রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন শাহীনুর। বস্তির ছাপড়া ঘরের ভাড়া গোনা আর আনুসঙ্গিক বিল পরিশোধের পর, বাজারের দিকে পা বাড়ানোর আগেই দেখেন হাত খালি। তিন মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন এই মধ্যবয়ষ্ক নারী। কিন্তু এক মেয়েকে এরইমধ্যে স্কুল ছাড়াতে হয়েছে। এটাই পোশাক শ্রমিকের জীবন।
তৈরি পোশাক খাতের অর্থনীতির গতির সাথে সাথে এই খাতের শ্রমিকের জীবন-জীবিকা অতীতেও তেমন গতি পায়নি। এখনো পাচ্ছে না। গেল বছর পোশাক শ্রমিকদের বেতন সর্বনিম্ন ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। যা আগে ছিল ৮ হাজার টাকা। এ বেতন বাড়ায় কিছুটা স্বস্তি ফিরবে বলে আশা করা হলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সে স্বস্তির দেখা মেলেনি। শাহীনুর তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
জীবিকার তাগিদে জীবনে সফলতার স্বপ্ন নিয়ে প্রতি বছর প্রায় ছয় লাখ মানুষ ঢাকা শহরে পাড়ি জমায় তাদের ভাগ্য বদলানোর আশায়। ঢাকায় আসা বিপুল সংখ্যক এ মানুষের মধ্যে নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত বেশির ভাগেরই ঠাঁই হয় রাজধানীর বিভিন্ন পোশাক কারখানায়। গ্রাম থেকে উঠে আসা এসব মানুষ দৈন্যদশা থেকে মুক্তি পেতে অল্প আয়ে নিজের শ্রম বিলিয়ে দিচ্ছেন পোশাক কারখানায়। কিন্তু তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি।
দৈনিক ৮-৯ ঘণ্টা কাজের বিনিময়ে ১২-১৩ হাজার টাকা মাসিক বেতনে কাজ করেন অনেকে। তবে এ অল্প আয় দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন পোশাক শ্রমিকদের পরিবারগুলো।
বাসা ভাড়া, সংসার খরচ, দিয়ে কেমন কাটছে পোশাক শ্রমিকদের জীবন? এ বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন বার্তা২৪.কমের এই প্রতিবেদক। বৃহস্পতিবার (২৫এপ্রিল) রাজধানীর মিরপুর এলাকার কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকের সাথে সরেজমিনে কথা বলে জানা গেছে তাদের অবস্থার কথা।
মিরপুর শেওড়াপাড়ান একটি কারখানার পোশাক শ্রমিক শাহিনুর বেগম থাকেন পীরেরবাগ এলাকায় । বার্তা ২৪ কে তিনি বলেন, "স্বামীর একার রোজগারে সংসার চলেনা। তাই নিজেও কাজে গেছি। কিন্তু তাতেও চলে না। সকাল ৮ টায় যাই আর বিকাল পাঁচটায় ফিরি। মাসে সাড়ে ১২ হাজার টাকা পাই। হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর যা পাই তা বাসা ভাড়া, কারেন্ট বিল, পানির বিল দিতেই শেষ হয়ে যায়।"
"আমার তিন মেয়ে। ছেলে নাই। তাদের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারি না। এক মেয়ের পড়া বন্ধ করে দিছি," বললেন শাহীনুর।
ভাগ্যের এই করুণদশার জন্য দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিকেই দায়ী করেন শাহীনুর। তিনি বলেন, একটু খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য দুই জন কাজ করি। তাও তিনটা মেয়েকে নিয়ে এই শহরে চলতে পারি না। এইটাই দুর্ভাগ্য।"
আরেক পোশাক শ্রমিক আলাউদ্দিন বরিশালের পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া থানা থেকে জীবিকার সন্ধানে এসে যোগ দেন রাজধানীর একটি গার্মেন্ট কারখানায়। সেখানে আয়রন ম্যানের কাজ তার। মাসিক মজুরি ১২০০০ টাকা।
কাজের জায়গায় অনেক চাপ থাকে। ঘড়ির কাটার এদিক-ওদিক হওয়ার কোন সুযোগ নেই। সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট কাজ না করতে পারলে চাকরি চলে যাবে। বার্তা২৪ কে আলাউদ্দিন বলেন, "অভাবের তাড়নায় লেখাপড়া বেশি দূর করতে পারিনি। গ্রামে যখন কিছু করতে পারলাম না ঢাকা শহর চলে আসলাম। গার্মেন্টসের আয়রন ম্যানের কাজ পাইলাম। এই গরমে খুব কষ্ট হয় সে কাজ করতে। কিচ্ছু করার নেই। শেওড়াপাড়ায় মেসে থাকি। খাওয়া-থাকা বাবদ নিজেরই মাসে ৭-৮ হাজার টাকা খরচ হয়। বাকি টাকা বাড়িতে পাঠাই। তাতে মায়ের ওষুধ কিনতে হয়।
"মায় বলে সংসার শুরু করতে, বিয়া করতে। আমি বলি নিজেই চলতে পারিনা, বউরে খাওয়ামু কি!"
আরেক গার্মেন্টস কর্মী রোজিনা বলেন, "আগে আট হাজার টাকা ছিল এখন ১২ হাজার টাকা হইছে। কিন্তু এই যুগে আইসা এই টাকায় সংসার চলেনা। বাজারে মাছ-মাংসের আগুন ছোঁয়া দাম। ব্রয়লার মুরগিও প্রায় আড়াইশো টাকা কেজি। আমার স্বামীর নিত্য আয় নিত্যই ব্যয় হয়ে যায়। মাইয়া দুইটা বড় হইতাছে, বিয়া যে দিমু কিছুই সঞ্চয় নাই।"
তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান একটি খাত। অর্থনৈতিক চালিকা শক্তির এখাতে স্বল্পদরে শ্রম কিনে ভারী হয় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আর মালিকপক্ষের বাড়ে শান-শওকত। কিন্তু দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেও শ্রমিকেরা দেখেননা সুখের মুখ। যতটুকু যাও বাড়ে আয়, সব শেষ হয়ে যায় বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ধাক্কায়। সুতরাং তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকের জীবনে নেই সামান্য পরিবর্তন।