সিলেট বন্যার দায় কার, সমাধান কী?

, জাতীয়

রাজু আহম্মেদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট বার্তা২৪.কম | 2024-06-21 12:24:46

সিলেট থেকে: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এবং দেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত সিলেট। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ জেলা হিসেবেও পরিচিত এ নগরী। শিল্প, প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক ভাবে সিলেট দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ধনী জেলা। প্রাকৃতিক গ্যাস, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও এ জেলার মানুষের ভূমিকা অনেক বেশি।

তবে এ জেলায় প্রতি বছর বন্যার কবলে পড়েন কয়েক লাখ মানুষ। জেলা শহর থেকে শুরু করে এ জেলার অধিকাংশ ইউনিয়ন বন্যা কবলিত। ২০২২ সালে ভয়াবহ বন্যা ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেনি এখনো অনেক অঞ্চলের মানুষ। এর মধ্যে আবারও কয়েক দফায় বন্যার কবলে পড়েছে অন্তত ১৫ লাখ মানুষ।

সম্প্রতি টানা বৃষ্টিপাত ও ভারত থেকে আসা উজানের ঢলে প্লাবিত হয়েছে সিলেট নগরীসহ ১৩টি উপজেলা। এসব উপজেলার ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে দিন কাটাচ্ছে। জীবন বাঁচাতে সিটি করপোরেশন (সিসিক) ও জেলা প্রশাসনের ১৩০টি আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে লাখ লাখ মানুষ।

প্রশ্ন হচ্ছে সমৃদ্ধশালী এ জেলা কেন বন্যার কবলে? কেনই বা বন্যা মোকাবিলার পদক্ষেপ নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সিলেট জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমাসহ ৪টি নদীর গর্ভে বছরের পর বছর পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে অল্প বৃষ্টি কিংবা উজানের ঢল সামলাতে পারে না নদীগুলো। নদী গর্ভ ভরাটের কারণে প্লাবিত হয় নিম্নাঞ্চল। কয়েক বিলিয়ন টন পলি আসছে বছরের পর বছর। এতে নদী নাব্যতা কমে গিয়ে শহরের ড্রেন দিয়ে নদীর পানি নগরীতে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে নদী খনন বড় সমাধান হতে পারে সিলেটের বন্যা নিরসনের।


স্থানীয়দের অভিযোগ, নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার না করা ও আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় বার বার জলাবদ্ধতায় ভুগছে সিলেটবাসী। এছাড়া শহরের খাল-বিল ভরাট ও দখলের কারণে পানি নিষ্কাসনের সুযোগ নেই। ফলে অল্প বৃষ্টিতে তলিয়ে যাচ্ছে সিলেট নগরী।

নদী ভরাট ও কর্তৃপক্ষের অবহেলায় প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে এ জেলার। পর্যটনেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে এ অঞ্চলে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতির কারণে প্রতি বছর কয়েক লাখ মানুষ ভুগছে বন্যায়।

স্থানীয়দের দাবি, ডেল্টা বা মেগা প্রকল্পের আওতায় খনন করা প্রয়োজন সুরমাসহ আশেপাশের নদনদী। সাথে আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা, ও শহর নিরাপদ প্রকল্প গ্রহণ করে জলাবদ্ধতা কমাতে হবে। এতে যেমন নদীর নাব্যতা ফিরে আসবে। সাথে সমাধান হবে বন্যা সমস্যা।

সিলেট নগরীর জাঙ্গালপুর এলাকার শারিফুল আলম বলেন, প্রতি বছর আমরা এই ভোগান্তিতে পড়ি। নগর পরিকল্পনার বড় ঘাটতি আছে। সড়ক ও ড্রেন নির্মাণের পরিকল্পনা সঠিক করতে হবে। ড্রেন নিয়মিত পরিষ্কার ও নদ নদী খনন করলে আমরা এই ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাব।

উপশহর এলাকার আরমান আলি বলেন, বাড়িতে হাঁটু সমান পানি। বাসা থেকে বের হতে হলে গামছা নিয়ে বের হতে হয়। ড্রেন দিয়ে অন্য এলাকার পানি আসছে আমাদের মহল্লায়। কী এমন ড্রেন, যা ব্যবহার হচ্ছে উলটো দিকে? আমরা সঠিক সমাধান চাই। নদী খনন ও ড্রেন পরিষ্কার করার দাবি জানাই।

তবে নদী গবেষক ও স্থানীয়দের দাবির উল্টোটা বলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা দিপক রঞ্জন দাস জানান, নদী খনন কিংবা ড্রেসিংয়ে বন্যা মোকাবেলা সম্ভব নয়। প্রয়োজন সকল দপ্তরের সমন্বয়।

রাস্তা বা অবকাঠামো নির্মাণে সময় নদীর পানির উচ্চতা পরিমাপ করেই নির্মাণ না হওয়ায় এমন সমস্যা দাবি করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক দীপক রঞ্জন দাস বলেন, নদী খনন বন্যা সমস্যা সমাধান হবে তা বলা যায় না। আসলে ১৮ কিলোমিটার খনন করে কিছু হবে না। এক্ষেত্রে সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণে সচেতন হতে হবে। নদীর নাব্যতা বিবেচনা করে নির্মাণ করতে হবে। শুধু পানি উন্নয়ন বোর্ড নয়, সকল দপ্তরের সহযোগিতা প্রয়োজন। সমন্বয় করে কাজ করলে সমাধান করা যাবে।

তিনি বলেন, আমরা বেশ কিছু নদী খননের প্রস্তাব করেছি। দ্রুত এটা অনুমোদন হবে আশা করি।

এদিকে সিসিক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলছেন, নদী খনন করে নাব্যতা ফেরালে অনেকটাই কমে আসবে বন্যার ভয়াবহতা। ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নতিও জরুরি বলছেন তিনি। নিজ উদ্যোগে নদী খনন ও জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়ার তাগিদ দেন সিলেটের মেয়র।

তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে মিটিং করেছি। সিলেট সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকায় সুরমা নদীর গতিপথ ১৮ কিলোমিটার। এই ১৮ কিলোমিটার খনন করা গেলে নদী গর্ভ বৃদ্ধি পাবে৷ এতে নদীর উপরের স্তর নেমে যাবে। পানিও নদীর গর্ভে থেকে বাইরে আসবে না। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড এটা মানতে নারাজ। তাই নিজস্ব প্রকল্পের আওতায় সিটি করপোরেশন এই খনন কাজ করবে।

হাওর ও নদী গবেষক কাশমির রেজা বার্তা২৪.কমকে বলেন, নদী খনন সিলেটের বন্যা নিরসনের বড় সমাধান হতে পারে। মূলত প্রতি বছর পলি আসছে ভারত থেকে। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় পলি আসার পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে নদী গর্ভ ভরাট হয়ে শহরের খাল বিল ড্রেন দিয়ে পানি বসতভিটায় চলে আসছে।

তিনি বলেন, নদী খনন ও ড্রেজিং সমাধান তখনই হবে, যখন দ্রুত খন কাজ বাস্তবায়ন হবে। দীর্ঘ সময় নিলে তা কাজে আসবে না। সে ক্ষেত্রে ডেল্টা বা মেগা প্রকল্প প্রয়োজন। মূলত বৃহৎ প্রকল্পের মাধ্যমে এটি করতে হবে। এছাড়া শহর রক্ষা ও হাওর রক্ষা বাধ নির্মাণে আরও গবেষণা ও আধুনিক বাস্তবায়ন করা গেলে দ্রুত বন্যা সংকট নিরসন সম্ভব হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর