নগরে সবুজের মেলা

, জাতীয়

রুহুল আমিন ও গুলশান জাহান সারিকা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-07-05 15:32:51

আমকে বলা হয় ফলের রাজা। দেশে গোপালভোগ, ক্ষীরশাপাতি, ফজলি, ল্যাংড়া, আম্রপালিসহ আরও বেশ কয়েক ধরনের আমের চাষ হয়। এসব আসে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও নওগাঁ থেকে। ফলে গাছ থেকে পেড়ে খাওয়ার সৌভাগ্য হয় না রাজধানী শহরে থাকা অনেকেরই। তবে এবার সে সুযোগ মিলছে খোদ রাজধানীতে।

শুধু আম নয় জাতীয় ফল কাঁঠাল থেকে শুরু করে জাম, কলা, লিচু, বেল, লটকন, খেজুর, মাল্টা, সুইট লেমনসহ আরও শত শত প্রজাতির ফলসহ গাছের দেখা মিলছে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পুরাতন বাণিজ্য মেলার মাঠে। নিজ হাতে পেড়ে খাওয়ারও মিলছে সুযোগ; তবে সে জন্য কিনতে হবে গাছ।

গত ৫ জুন থেকে শুরু হয়েছে জাতীয় বৃক্ষমেলা-২৪।  বৃক্ষমেলার এবারের প্রতিপাদ্য 'বৃক্ষ দিয়ে সাজাই দেশ, সমৃদ্ধ করি বাংলাদেশ'। বন অধিদপ্তরের এবারের মেলায় শুধু ফলের গাছই নয়, দেখা মিলছে ফুল, ঔষধি, বনজ, ঘর সাজানোর অর্কিড, বনসাইসহ দেশি-বিদেশি কয়েক হাজার প্রজাতির প্রায় কয়েক লক্ষাধিক গাছের।


সরেজমিনে বুধবার (৩ জুলাই) মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা মেলে এক চিরায়ত বাংলার। এক সবুজের সমারোহের যে বাংলার কথা বলে গেছেন জীবনানন্দ দাশ থেকে সামসুল হক। কংক্রিটের এই শহরে একটু যেন অভিশাপমুক্ত অক্সিজেন।

মেলায় নেই কোন প্রবেশ ফি, তাই টিকেট কাটারও নেই বাড়তি ঝামেলা। গেইট দিয়ে ঢুকেই ডানে, বামে ও সোজা তিনদিকে চলে গেছে তিনটি রাস্তা। চারদিকে শুধু গাছ; ফলের গাছ, ফুলের গাছ, বাহারি পাতার বাহারি রঙের গাছ। ফল, ফুল, বনজ সব মিলিয়ে এক অন্যরকম আবহ।

হাতের ডান দিয়ে ঢুকে দুই/তিনটি দোকান পার হলেই দেখা মেলে কিশোরগঞ্জ নার্সারির। সেখান থেকে গাছ কিনছিলেন মোসাল্লেমা আক্তার। মেলায় এসেছেন দুই সন্তানকে নিয়ে। গাছও কিনেছেন বেশ কয়েকটি। দরদাম করছিলেন গাছ বহনকারী ব্যক্তির সঙ্গে। গাছ কেনা শেষ? জানতে চাইলে বার্তা২৪.কমকে তিনি বলেন, কিছু কিনেছি আরও কিছু নিবো।


মেলায় এসে কেমন লাগছে, এমন প্রশ্নের জবাবে মোসাল্লেমা বলেন, এখন পর্যন্ত ৭/৮ বার চলে আসছি। বাসা এখানেই (আগারগাঁও) তাই যখনই কোন গাছের কথা মনে হয়, চলে আসি। গাছ কেনা এখন আমার নেশায় পরিণত হয়েছে।

শহরে তো জায়গার সীমাবদ্ধতা, এতো গাছ কিনছেন লাগাবেন কোথায় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার ফ্ল্যাট মোটামুটি বড়। চারটি বারান্দা আছে, এর মধ্যে একটিতে অর্কিড বাগান করেছি ও বাকি তিনটিতে বিভিন্ন ফুলের গাছ লাগিয়েছি। আবার ছাদেও ছোট একটি ছাদ বাগান বানিয়েছি, যেখানে নানা প্রজাতির ফল গাছ আছে। এগুলোর  জায়গাও সেখানেই হবে।

সেখান থেকে মোসাল্লেমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সামনে আগাতে থাকি। এমন সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ আর গাছ-গাছালির কলতানে সবাই তাকিয়ে আছে সবুজের সমারোহের দিকে, টুপ টুপ করে পড়া বৃষ্টির ফোটা গাছের পাতা, কাণ্ড, ডাল হয়ে গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে আবার কোথাও বা পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে আম, জাম, কাঁঠাল বা অন্য কোন ফলের গায়ে।  


মোট চার সারিতে থরে থরে বিভিন্ন জাতের গাছের পশরা সাজিয়ে বসেছেন মানিকগঞ্জ নার্সারির মালিক মো. আজমত আলী। কয়েকশ' প্রজাতির প্রায় কয়েক হাজার গাছ আছে তার এই বাগানে। গোলাপ, গাঁদা, কনকচাঁপা, নয়নতারা, টগর, জুঁই থেকে শুরু করে আম, কাঁঠাল, জাম্বুরা, কমলা, বেদানা ও মাল্টাসহ এরকম দেশি-বিদেশি নানা জাতের নানান গাছ। তবুও হাসি নেই তার মুখে।

বেচা-বিক্রি কেমন জানতে চাইলে আজমত আলী বার্তা২৪.কমকে বলেন, মোটামুটি বিক্রি হচ্ছে। তবে অন্যান্য বারের তুলনায় এবার বিক্রি কম। সেই সাথে বের হয়ে আসে মুখে হাসি না আসার কারণও। কী গাছ বেশি বিক্রি হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফুলের গাছ বেশি বিক্রি হচ্ছে। তবে ফলও হচ্ছে, এর মধ্যে আম গাছটাই মানুষ বেশি নিচ্ছে।

বিক্রি কম কেন জানতে চাইলে আজমত আলী বলেন, মেলা শুরু হয়েছে ঈদের আগে, ঈদের কারণে তখন লোকজন খুব একটা আসেনি। এখন ঈদ শেষে ক্রেতারা আসছেন, তবে সে সংখ্যাও বেশি না।

এবারের মেলায় আলোচনায় এসেছে যে দুটি গাছ এর মধ্যে একটি খান নার্সারির বারহি জাতের সৌদিয়ান খেজুর গাছ। গাছটিতে প্রায় ৬/৭ থোকায় ধরে আছে খেজুর, তবু ক্রেতা পাচ্ছেন না নার্সারিটির মালিক।

এবারের মেলায় বিক্রি কেমন জানতে চাইলে নার্সারিটির মালিক সজিব হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, এখন পর্যন্ত বেচা-বিক্রি মোটামুটি!

মোটামুটি কেন? আপনার খেজুর গাছ তো 'সেলিব্রিটি হয়ে গেছে' এমন প্রশ্নের জবাবে সজিব বলেন, এটাই আরও বিক্রি কমিয়ে দিছে। মানুষ খালি থাকলে আসে, কিন্তু এই খেজুর গাছের কারণে কেউ আসছে না। আর যারা আসে সবাই ছবি তুলতে আসে। কিন্তু ক্রেতারা কম আসে।


'সেলিব্রিটি' খেজুর গাছের দাম কত জানতে চাইলে এই বিক্রেতা বলেন, আমরা তো ৬ লাখ টাকা চাচ্ছি। ক্রেতা পাচ্ছেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ঈদের আগে কয়েকজন জিজ্ঞেস করলেও ঈদের পর আর কেউ দামও জানতে চাচ্ছে না!

মেলা ঘোরা শেষে বেরিয়ে যাবার সময় দেখা হয় আরেক গাছপ্রেমি সানজিদা আক্তারের সঙ্গে। মেলায় মেয়েকে নিয়ে এসেছেন। থাকেন রাজধানীর গ্রিনরোডে। বাসায় বারান্দা আছে তিনটি, সবগুলোই ভর্তি গাছে। তবু গাছ কেনার সাধ যেন শেষ হয় না তার। বাসার কোন জায়গায় আর ফাঁকা আছে, কতটুকু ফাঁকা আছে, কোন গাছটিকে রাখা যাবে এনিয়েই আলাপ করছিলেন মেয়ের সঙ্গে।

এমন সময় উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করি, বৃক্ষমেলায় গাছ কেনায় কেমন লাগছে? প্রশ্নের জবাবে সানজিদা বার্তা২৪.কমকে বলেন, গাছ বলতেই আমি পাগল। যা দেখি সবই ভাল লাগে, ইচ্ছে হয় সবই নিয়ে যাই, কিন্তু বাসায় আর জায়গা নেই। তারপরও একটি কসমস ফুলের গাছ নিছি, আরও দেখছি কী নেওয়া যায়।

এবারের মেলায় সরকারি-বেসরকারি ৮০টি প্রতিষ্ঠান ও নার্সারির ১২০টি স্টল বসেছে। যেখানে প্রায় দেশি-বিদেশি ২ শতাধিক প্রজাতির ফলদ, বনজ ও শোভাবর্ধক গাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। এর মধ্যে বেশি বিক্রি হচ্ছে ছাদ-বাগান ও ঘর সাজানোর গাছ। গাছের পাশাপাশি বীজ, সার, মাটি, কীটনাশক, টব, ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন, টব বা গাছ রাখার বিভিন্ন আসবাবপত্রও বিক্রি হচ্ছে।

মেলার তথ্যকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা বন্যপ্রাণি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা সোহেলা সরকার বার্তা২৪.কমকে বলেন, মেলার প্রথমদিকে বিক্রি কিছুটা কম থাকলেও এখন বিক্রি বাড়ছে। তখন যেহেতু ঈদ ছিল, তাই ক্রেতার উপস্থিতি কম ছিল। ঈদের পর থেকে সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।

ক্রেতারা সাধারণত সন্ধ্যার দিকে বেশি আসেন জানিয়ে এ কর্মকর্তা আরও জানান, গত ১ জুলাই পর্যন্ত পাওয়া হিসেবে এখন পর্যন্ত মেলা থেকে গাছ বিক্রি হয়েছে ২১ লাখ ৬১ হাজার ১০৩টি। যার মোট মূল্য ১১ কোটি ৮১ লাখ ২ হাজার ৬৮৭ টাকা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর