গাইবান্ধায় দুর্ভোগে বন্যার্ত মানুষ, আশ্রয় নিচ্ছেন বাঁধে

, জাতীয়

মাসুম বিল্লাহ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, গাইবান্ধা | 2024-07-06 14:19:23

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল এবং গেল সপ্তাহের থেমে থেমে ভারি বৃষ্টিতে গাইবান্ধার সদর, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলাসহ চার উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ২৯টি ইউনিয়নে অন্তত ৭০ হাজার পরিবার। টানা পাঁচদিন যাবত বন্যায় বাড়ি-ঘরে পানি ওঠায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে ওইসব এলাকার বন্যার্ত মানুষেরা। দেখা দিয়েছে রাতের আশ্রয়, বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট। বানভাসি মানুষেরা গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ও কঠিন সময়ের শেষ সম্বলটুকু নিয়ে আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন নিকটবর্তী বাঁধে। 

জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, শনিবার দুপুর পর্যন্ত গাইবান্ধার সদর উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন, সুন্দরগঞ্জে ৯টি, সাঘাটায় ৮টি ও ফুলছড়ি উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন পানবন্দি হয়ে পড়েছে । এই ২৯ ইউনিয়নে পানিবন্দি ৬৭ হাজার ৭২৯টি পরিবার। এরমধ্যে গাইবান্ধা সদর উপজেলায় ৩৯ হাজার ৮৮৯টি , সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় ৫২ হাজার সাঘাটা উপজেলায় ১৫ হাজারর ১৫০টি ও ফুলছড়ি উপজেলার ৭ হাজার ৪৯০টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। যদিও স্থানীয়দের দাবি বাস্তবে পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

ছোট্ট শিশুকে পাশে শুইয়ে রেখে আলগা চুলায় খাবার তৈরি করছেন এক নারী। ছবি:বার্তা ২৪ 

সরেজমিনে শুক্রবার দুপুরে জেলার ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের মধ্য কাতলামারি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বন্যায় পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে বাড়ি-ঘর, ফসলি জমি। এসব এলাকার চারদিকেই থৈ থৈ পানি। নিম্নাঞ্চলের সাথে নদী তীরবর্তী এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়েছে পড়েছে। তলিয়ে গেছে টয়লেট-টিউবয়েল। আঙিনা, বাহিরে, ঘর-দরজায় সবখানেই পানি আর পানি। ফলে বন্যার্ত মানুষেরা আশ্রয় নিতে শুরু করেছে পুরাতন বাঁধে। তারা গৃহপালিত পশু নিয়ে বাঁধে উঠেছেন। বাঁধে অনেকেই বাঁশ, পলিথিন পাটকাঁঠি ও খড় ব্যবহার করে অস্থায়ী ঘর তৈরি করছেন। বাঁধের অস্থায়ী ঘরের পাশেই রান্না করছেন নারীরা। এসময় ছোট্ট শিশুকে পাশেই শুইয়ে রেখে আলগা চুলায় এক নারীকে খাবার তৈরি করতে দেখা গেছে।

এদিকে, চার উপজেলার বন্যা কবলিত এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠে ও শিক্ষাঙ্গনে ভিতরে বন্যার পানি ওঠায় গত তিনদিন আগে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ ও মাদ্রাসাসহ জেলার ৮১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রমও বন্ধ ঘোষণা করেছে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বিভাগ। অন্যদিকে, পানিতে নিমজ্জিত ও তলিয়ে গেছে ৩ হাজার ৮৯০ হেক্টর আউশ ধান, পাট, ভুট্টা ও আমন বীজতলা। তলিয়ে গেছে পুকুর ও মাছের ঘের।

মধ্য কাতলামারি গ্রামের আব্দুর রশিদ বলেন, 'আমরা পাঁচদিন থেকে পানিবন্দি। বাড়ি-ঘর, আঙ্গিনা সব খানেই পানি। পায়খানা-টিউবয়েল তলিয়ে গেছে। খুব চেষ্টা করেছি বাড়িতে থাকার কিন্তু পানিতে থাকতে থাকতে না পেরে গতকাল বাঁধে বাঁশ-পলিথিন দিয়ে ঘর তুলেছি। এই ঘরেই গরু, বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকতে হবে।'

চারদিকে থৈ থৈ পানি, তলিয়ে গেছে টিউবওয়েলও। ছবি:বার্তা ২৪

কোহিনূর বেগম বলেন, 'বাড়ি-ঘরে পানি ওঠায় সকালে রান্না-বান্না করতে পারিনি। পরে বাঁধে চুলার ব্যবস্থা করে সকালের খাবার দুপুরে করতেছি। আমাদের পানি আর খাবারের খুব সংকট হয়েছে। এছাড়া আমরা মহিলা মানুষ পায়খানা-গোসলেরও সমেস্যায় পড়েছি। আমাদের শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, মোম-দিয়াশলাই খুবই প্রয়োজন।'

গজারিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান খোরশেদ আলী খান বার্তা২৪.কমকে বলেন, 'বর্তমানে এই ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। কিছু লোক বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা শুকনা খাবার, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও নদগ টাকাও বিতরণ শুরু করেছি। পর্যায়ক্রমে সব এলাকাতেই বিতরণ করা হবে।'

গাইবান্ধার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, শনিবার দুপুর ১২টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি জেলার ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখ পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ১ সেন্টিমিটির কমে বিপদসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া ঘাঘট নদীর পানি জেলা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে ৩ সে.মি. কমে বিপদসীমার ৩৫ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে, জেলার করতোয়া নদীর পানি গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালি পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেলেও বিপদসীমার ১৪৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং তিস্তা নদীর ২৯ সে.মি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

গাইবান্ধার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাফিজুল হক মোবাইল ফোনে বার্তা২৪.কমকে জানান, 'আজ গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র ১ সেন্টিমিটার ও ঘাঘটে ৩ সেন্টিমিটার পানি কমেছে। সুন্দরগঞ্জ, সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার ২৯টি ইউনিয়ন বর্তমানে বন্যা কবলিত। পানি উন্নয়ন বোর্ড সার্বিক পরিস্থিতির উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখছে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।'

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসকের সহকারি কমিশনার (এনডিসি) মো. জুয়েল মিয়া বার্তা২৪.কমকে জানান, বন্যা কবলিত চার উপজেলায় ৩ হাজার ৫০ প্যাকেট শুকনা খাবার, ১৬৫ মেট্রিক টন চাল, ১০ লাখ নগদ টাকা উপবরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চার উপজেলায় দুই হাজার পরিবারের মাঝে বিকাশের মাধ্যমে ১০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া বন্যার্ত ১ হাজার ৯০০ জন নারীর মাঝে নারীর মর্যাদা সুরক্ষা উপকরণ সামগ্রী হিসেবে শাড়ি, মশারি, সাবান, তেল ও স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ ১৬ ধরনের উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া জেলায় ১৮১টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর