পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়েছে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী রেল সেতু। যমুনার পশ্চিম তীরকে যুক্ত করেছে পূর্ববর্তী টাঙ্গাইল স্টেশনে। এখন চলছে উভয় পাশের রেল স্টেশন নির্মাণের কাজ। আগামী ডিসেম্বরে কু-ঝিক ঝিক শব্দে ছুটবে রেল।
দেশের উত্তরাঞ্চলের রেল যোগাযোগে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল মধ্যবর্তী স্থানে যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু। তবে এই প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে সরকারের উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে যমুনার বুকে বিকল্প রেল সেতু। ইতিমধ্যেই সেতুটির ৯০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে। বাকি কাজ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই সেতু দিয়ে রেল চলাচল শুরু হবে।
ফলে বর্তমানের ধীরগতিতে (২০ কি.মি) পার হওয়া রেল ছুটবে ১২০ কিলোমিটার গতিতে। ফলে বাঁচবে সময়, কমবে ভোগান্তি। এই সঙ্গে এক প্রান্তের রেল পার হওয়ার সময় অন্য প্রান্তে অপেক্ষা করতে হবে না বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রেনের। ফলে উভয় পাশ থেকে আশা ট্রেনের অপেক্ষা ছাড়াই পার হওয়া যাবে নির্বিঘ্নে। একই সঙ্গে বর্তমানে এই রুটে ৪৪টি ট্রেন চলাচল করলেও এই সেতুটির কাজ শেষ হলে দ্বিগুণ ট্রেন চলাচল করতে পারবে বলে জানা গেছে।
এই রুটে মাত্র ২০ কিলোমিটার গতিতে সেতু পার হতে হয় চলাচলকারী রেলগুলোর। এছাড়াও এই পারাপারে সিঙ্গেল গেজ লাইন হওয়ায় একটি ট্রেন পার হওয়ার সময় অন্য আরেকটি ট্রেনকে সেতুর অন্যপাড়ের স্টেশনের সিগন্যালের অপেক্ষা করতে হয়। ফলে মাত্র ৫ কিলোমিটারের এই সড়ক পারি দিতে পার হয়ে যায় দীর্ঘ সময়। কখনও কখনও সময় লাগে এক দেড় ঘণ্টারও বেশি।
এসব সমাধানে যমুনা নদীতে বর্তমান চলমান বঙ্গবন্ধু সেতুর থেকে ৩০০ মিটার উজানে নির্মিত হচ্ছে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ডাবল গেজ লাইনের দেশের বৃহত্তম বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হবে এ সেতুর নির্মাণ কাজ। একই সঙ্গে সেতুর দুইপ্রান্তে পুনর্নির্মিত রেলস্টেশনের কাজ শেষ হয়েছে ৬০ শতাংশ।
বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. মাসুদুর রহমান বলেন, নবনির্মিত রেলসেতুর কাজের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯০ শতাংশ।
বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর কাজ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করে অপারেশনে আসতে পারবে জানিয়ে তিনি বলেন, এ প্রকল্পে এখন কোন চ্যালেঞ্জ নেই, সব ঠিকভাবে চলছে।
অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শেখ নাইমুল হক বলেন, বঙ্গবন্ধু রেল সেতু প্রকল্পের কাজ ডিসেম্বরে শেষ হলেও যাত্রী চলাচল শুরু হতে জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। বর্তমানে ফিক্সিং ও ট্র্যাক বসানো হচ্ছে। সেই সাথে সাথে টেলিকমিউনিকেশনের কাজও শেষ করা হচ্ছে।
ভোগান্তি কমবে জানিয়ে তিনি বলেন, সেতুর কাজ শেষ হলে ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। ফলে সেতু পার হতে সময় লাগবে তিন থেকে ৪ মিনিট, আর কমবে ভোগান্তি।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের অক্টোবরের হিসাব অনুযায়ী বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে দিনে ৪৪টি ট্রেন চলাচল করে। সেতুটিতে পূর্ণ গতিতে ট্রেন চলতে না পারায় এবং সিঙ্গেল-ট্র্যাক রেলপথ হওয়ায় সেতু পার হতে অধিক সময় খরচ হয়, ফলে ট্রেনগুলো শিডিউল বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে পড়ে। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার গতিতে চলা একটি ট্রেন সেতুর পূর্ব পাশের স্টেশন থেকে পশ্চিম পাশের স্টেশনে পৌঁছোতে প্রায় আধা ঘণ্টা সময় নেয়।
এছাড়াও সেতুতে ওজন সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে ভারী পণ্যবাহী ট্রেন চলতে পারে না। বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশটির উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের চলাচলকারী ট্রেনগুলো গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় গড়ে ২ ঘণ্টা কমে যাবে। পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে রেলপথে পণ্য পরিবহনের সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়াও অভ্যন্তরীণ রুটে সহজে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে এ সেতুটি কাজে লাগবে। এ ছাড়াও সেতুটি সার্ক, বিমসটেক, সাসেক ও অন্যান্য আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক রেলওয়ে রুট এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথ নেটওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ। সেতু নির্মাণ হলে বঙ্গবন্ধু সেতুর রেলপথ তুলে ফেলা হবে।
প্রকল্প ও অর্থায়ন
২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রথমে সেতুটির নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এ জন্য ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার, যার মধ্যে জাপানের উন্নয়ন সহযোগিতা প্রতিষ্ঠান জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা দেবে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল।
তবে পরবর্তী সংশোধিত প্রকল্পে সময়সীমা দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। একইসঙ্গে প্রকল্প ব্যয় ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা করা হয়েছে। নির্মাণ ব্যয়ের ৭২% ঋণ সহায়তা দেবে জাইকা। বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।
প্রকল্পটি পৃথক দুটি প্যাকেজে বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে একটি ডব্লিউডি-১ প্যাকেজে বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্প পূর্বাঞ্চলের সিভিল ওয়ার্ক এবং প্যাকেজ ডব্লিউডি-২ বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু নির্মাণ পশ্চিমাঞ্চলের সিভিল ওয়ার্ক। সেতুর পূর্ব অংশ নির্মাণ করবে ওবায়শি করপোরেশন, টিওএ করপোরেশন এবং জেএফই। এই অংশের জন্য ব্যয় হবে ৬ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। আইএইচআই এবং এসএমসিসির যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হবে পশ্চিম অংশ। এই অংশে ব্যয় হবে ৬ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর সেতুর ভিত্তি স্থাপন করা হয়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৮ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
অবকাঠামো
এ সেতুটি ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ। উভয় প্রান্তে মোট প্রায় ০.০৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট, প্রায় ৭.৬৬৭ কিলোমিটার এপ্রোচ এম্বানকমেন্ট এবং লুপ ও সাইডসহ মোট প্রায় ৩০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। সেতুটি সম্পূর্ণ ইস্পাত দিয়ে নির্মাণ করা হবে। প্রায় ৫০টি পিলারের ওপর কংক্রিটের ওপর রেলপথ বসানো হবে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সেতুতে স্টিল পাইপ শিট পাইল (এসপিএসপি) ফাউন্ডেশন, সেতুতে স্লিপার থাকবে না, ওয়েদারিং স্টিল (যা মরিচা ও ক্ষয় প্রতিরোধী) এবং ড্রিলমে প্রিভেনশন গার্ড (দুর্ঘটনা প্রতিরোধক) এরকম নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। এতে ডুয়েল গেজ ডাবল-ট্র্যাক রেলপথ থাকবে। সেতুতে ব্রড-গেজ ট্রেন ১২০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা এবং মিটার-গেজ ট্রেন ১০০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিতে চলাচল করবে। এছাড়াও সেতুতে দৈনিক মোট ৮৮টি ট্রেন চলাচল করবে।