চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে দেশের ৬১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। যা মোট দারিদ্র্যের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এছাড়া হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ৬১ শতাংশ মানুষ অর্থ সংকটে পড়েছে এবং ২৭ শতাংশ ঋণ নিয়েছেন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) "বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য অভিঘাতের ফলে বাংলাদেশে দারিদ্র্য" শীর্ষক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সোমবার (১৫ জুলাই) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইডিএস কনফারেন্স রুমে বাংলাদেশ পারিবারিক আয় ব্যয় জরিপের ২০২২ (হেইজ) ভিত্তিতে এই গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির রিসার্চ ফেলো ড. আব্দুর রাজ্জাক।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন- স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাস্থ্য সেবা মেটাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খরচ করতে হয় বাংলাদেশে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবার ৭৩ শতাংশ ব্যয় মানুষের পকেট থেকে মেটাতে হয়। শুধুমাত্র আফগানিস্তানে এ খরচ বাংলাদেশের থেকে বেশি ৭৭ শতাংশ। অন্যদেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানে ৫৭ শতাংশ, নেপালে ৫১ শতাংশ, ভারতে ৪৯ শতাংশ, ভুটানে ১৮ শতাংশ এবং মালদ্বীপে খরচ হয় ১৪ শতাংশ।
অন্যদেশগুলোর তুলনায় খরচ বেশি হলেও জিডিপিতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ সবচেয়ে কম। জিডিপিতে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ মাত্র ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। যেখানে আফগানিস্তানে বরাদ্দ ২১ শতাংশ। মালদ্বিপে বরাদ্দ ১০ শতাংশ। একারণে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের মানুষকে অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হয়। ক্যান্সার চিকিৎসায় ৬ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা পযর্ন্ত ব্যয় করতে হয় বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একটি পরিবারের একজন সদস্য হাসপাতালে ভর্তি হলে গড়ে প্রায় ৫৫ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। আর এ খরচের প্রায় প্রায় ২৫ শতাংশ ওষুধের পেছনে ব্যয় হয়। হাসপাতালে ভর্তি না হওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে ৫৪ শতাংশ ওষুধের পেছনে ব্যয় হয়। আর এসব ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়তে হয়। স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বহন করতে সঞ্চয় ভেঙ্গে, ঋণ করে এবং সম্পদ বিক্রি করছে অধিকাংশ মানুষ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঋণ করে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বহন করতে হয় ২৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ মানুষের। ৩২ দশমিক ৫৮ শতাংশ খরচ করে সঞ্চয় ভেঙ্গে। বন্ধু-বান্ধবের কাছ সহায়তা নেয় ১৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আর ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে সম্পদ বিক্রি করে দিতে হয়।
প্রতিবেদনে মানুষের স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় কমাতে ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থা প্রণয়নের পরামর্শ দেন বিআইডিএসের গবেষক ড. আব্দুর রাজ্জাক সরকার। গত কয়েক বছর ধরে দেশে ওষুধের দাম বাড়ছে বলেও তিনি জানান।
বিনায়েক সেন বলেন, দেশে স্বাস্থ্য বীমা চালু করা প্রয়োজন। যেখানে মালিকপক্ষ তার কর্মীদের স্বাস্থ্য সেবার জন্য অর্থ দেবে। তাহলে চিকিৎসা ব্যয় অনেক কমে যাবে। জার্মানিতে ইউনিভার্সাল হেল্থ কেয়ার নিতে ১২৭ বছর লেগেছিল। ভারত ও চায়নার ৪০ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্য বীমার আওতায় এসেছে। এসব দেশে বীমার আওতায় আনতে ১২ বছর সময় লেগেছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, গ্রামাঞ্চলে এবং প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করাটাকে আমি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছি। আমরা যদি ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিসের যথাযথ চিকিৎসা এবং ওষুধ দিতে পারি তাহলে ঢাকা শহরে এত বড় বড় বিশেষায়িত হাসপাতালের দরকার হবে না।
এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, প্রেসক্রিপশন ছাড়া সামান্য সর্দি জ্বর হলেই এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে। এন্টি মাইক্রোবিয়াল রেসিস্টেন্ট ভয়ানক একটা জিনিস। এ প্রসঙ্গে আমি বলব, ডিজি ড্রাগকে আরও শক্ত হতে হবে। ফার্মেসিতে গিয়ে কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। প্রেসক্রিপশন ছাড়াই এন্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধে আমরা ডিজিটাল প্রেসক্রিপশন সিস্টেম চালু করার চেষ্টা করছি। ইলেকট্রনিক প্রেসক্রিপশন সিস্টেম যদি চালু করা যায় তাহলে যথাযথ মনিটরিং করা সম্ভবপর হবে। ওষুধের যথেচ্ছ এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, আমি মন্ত্রী হবার মেয়াদ মাত্র ছয় মাস। এই ছয় মাসে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন নিয়ে আমি অন্তত সাতটি সভা করেছি। আমি যেভাবেই হোক এটা মহান জাতীয় সংসদ নিয়ে যাব। কারণ, রোগী এবং চিকিৎসক উভয়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করাটা আমার দ্বায়িত্ব।
স্বাস্থ্যখাতের সমস্যা মোকাবিলায় সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে সামন্ত লাল সেন আরও বলেন, স্বাস্থ্যখাতের সমস্যা নিরসনে আমাদের একযোগে কাজ করতে হবে। এ ব্যাপার জনমত তৈরি করতে হবে। সাংবাদিক ভাইদের সহযোগিতায় এবং সৃষ্ট জনমতের কারণে পাঁচ বেড থেকে পাঁচশ’ বেডের বার্ন হাসপাতাল তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বার্ন হসপিটাল। একটা রোগীও বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে না। রোগীরা আইসিইউতেও পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাচ্ছে, স্থান সংকুলান হচ্ছে যেটা আগে সম্ভব ছিল না।