‘গেল তিনদিন ধইরা আমার মাইয়াডার অসুখ, তার মা কইলো অনেক জ্বর উঠছে, ওষুধ কেনার টাকা পাঠাইতাম। কিন্তু কারফু (কারফিউ) চলে দেইখা সব মার্কেট বন্ধ। গাড়ি নিয়া সেই সকালে বের হইয়া এহনো বইয়া রইছি। ২-৩দিন কোনো আয় রোজগারও নাই। আমার লগের সবারই এক অবস্থা। কারো কাছে ধারও পাই না। আইজ পরে একজনের কাছে থেকে ৫০০ টাকা নিসি, মাইয়াডার জন্য ওষুধ কিনতে পাঠামু। নিজে তিনবেলার জায়গায় দুই বেলা খাই। এভাবে কি চলা যায় কন?
আক্ষেপের সূরে কথাগুলো বলেছিলেন ভ্যান চালক বাবলু মিয়া। রাজধানীর বাংলামোটর, কাওরান বাজার, মগবাজার এলাকায় টাইলসসহ বিভিন্ন মালামাল ভাড়ায় আনা-নেওয়া করেন তিনি। কারফিউ থাকার দোকানপাট বন্ধ, তাই গাড়ি নিয়ে বের হলেও সারাদিন বসেই কাটিয়ে দিতে হচ্ছে তাকে।
শুধু বাবলু মিয়াই নন। আয় রোজগার বন্ধ হওয়ায় এমন অবস্থায় পড়েছেন অন্যান্য ভ্যান-রিকশাচালক, হকার ও অস্থায়ী চা-পান, সিগারেট, বাদাম বিক্রেতাসহ অন্যান্য দোকানীদের। ভাড়া না পাওয়া, বিক্রি না হওয়া ও দোকান খুলতে না পারায় অনেকে বাড়ি চলে গেছেন। তবে যাদের বাড়ি বেশি দূরে, তারা পড়েছেন বিপাকে। তাদের একজন রিকশাচালক নূর উদ্দিন মিয়া। থাকেন মগবাজার এলাকায়।
তিনি বার্তা২৪.কম-কে বলেন, 'গত ৪-৫ দিন ধইরা আয় কম। রিকশা নিয়ে বের হলেই মালিককে টাকা দিতে হয়, তাই গত দুইদিন বের হইনি। আজ বের হলাম। আগে হাজার বারশো টাকা আয় হলেও এখন তিন-চারশো আয় করতে কষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যে রিকশা ভাড়া দেওয়া লাগে। মালিককে দেওয়ার পর নিজের কাছে আর থাকে না। তিনবেলা কোনোভাবে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। মাস শেষ হলে আবার বাড়িতে টাকা পাঠান লাগে। এভাবে চললে না খাইয়া থাকা লাগবে।'
শুধু রিকশা আর ভ্যান চালকই নন, এমন অবস্থা হকার ও ফুটপাতে অস্থায়ী দোকান নিয়ে বসা মানুষেরও।
নিউ স্কাটন রোড়ে অস্থায়ীভাবে চায়ের দোকান করেন রফিক মিয়া। তিনি বলেন, কারফিউ চলায় রাস্তায় মানুষ নাই। দোকানও গত ৩দিন বন্ধ রাখছি। আজ শুনলাম দিনে কারফিউ থাকবে না। ঘরে শুয়ে বসে থাকলে পেট চলবে না। তাই দোকান খুলে বলসি। কিন্তু তেমন বিক্রি নাই।
মগবাজার, বাংলামোটর এলাকায় বুট, বাদাম বিক্রি করেন হৃদয়। তিনি বার্তা২৪.কম-কে বলেন, 'আগে যেখানে দিনে ৮-৯শ টাকা বিক্রি হতো, এখন সেখানে ২-৩শ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে ৭০-৮০ টাকা লাভ হচ্ছে। এই টাকা দিয়ে তো একবেলা খাওনও পাওয়া যায় না। আগের কিছু জমানো টাকা ছিল, সেগুলা ভেঙে খরচ করতেছি।'
রাস্তায় হেঁটে হেঁটে পান, সিগারেট বিক্রি করছেন শাকিল। পরিবার নিয়ে কাঁঠালবাগান থাকেন তিনি।
শাকিল বার্তা২৪.কম-কে বলেন, 'আগে ৫-৬শ টাকা আয় করতাম, এখন ২-৩শ আয় হয়। তিনজন মানুষ (তিন সদস্যের পরিবার) নিয়ে এই আয় দিয়ে কীভাবে চলবো বলেন। এখন ধারকর্জা কইরা চলতেছি, পরিস্থিতি ঠিক হয়ে গেলে আবার ইনকাম করে ধার ফেরত দিমু। কিন্তু এভাবে থাকলে আমাদের মতো মানুষের না খেয়ে মরতে হবে। দেশে কোনো সমস্যা হইলে সব ভোগান্তি আইয়ে আমগো ওপরে।'
এদিকে বাংলামোটর, কারওয়ার বাজার এলাকায় ভ্যানে করে আনারস, পেয়ারা বিক্রি করছেন মামুন মিয়া। তিনি বকশি বাজার এলাকায় পরিবার নিয়ে বাস করেন। কারফিউতে তার আয় রোজগার কমে গেছে। এতে সংসার চালাত হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।
তিনি বার্তা২৪.কম-কে বলেন, করফিউ চলায় নাকি ঢাকায় গাড়ি আসতে পারে না। তাই জিনিসপত্রের দাম বেশি। বেশি দামে কিনে এনেও আগের দামেই বিক্রি করছি। তাও কাস্টমার নাই। আগে আট থেকে দশ হাজার টাকা বিক্রি করতাম। এখন দুই থেকে তিন হাজারও বিক্রি করতে পারি না। পরিবার নিয়ে কীভাবে চলবো বলেন। মাস শেষ হলেও বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক খরচ ১০-১২ হাজার টাকা লাগে। এই মাসে তা মিলাইতে পারমু বলে মনে হয় না।
বাংলামোটর মোড়ে জুতা সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করেন আব্দুর রহমান। থাকেন সেগুনবাগিচায়। তিনি বলেন, 'রাস্তায় মানুষ না থাকায় ইনকামও নাই। পেট তো কারফিউ বুঝে না। তাই এসে দোকান খুলে বসি। তবে গত ৩-৪ দিনের তুলনায় আজ কিছু মানুষ বের হয়েছে। এভাবে চললেও তো আমরা বাঁচি। আমাদের তো দেখার কেউ নাই। আয় না হলে কেউ এসে জিজ্ঞাসাও করে না। কখনো কোনো সহযোগিতাও পাই না।'
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দলীয় নেতা-কর্মী ও সমাজের বিত্তবানদের খেটে খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) রাত থেকে সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। এ অবস্থায় বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষজন। চলমান কারফিউ কয়েক ঘণ্টার জন্য শিথিল হলেও প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হচ্ছেন না কেউ। ফলে আয় রোজগারে ভাটা পড়েছে এসব নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষদের।