নাশকতায় বন্ধ মেট্রোরেল, ভোগান্তি বেড়েছে সাধারণ মানুষের

, জাতীয়

অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা ২৪.কম, ঢাকা | 2024-07-30 10:02:54

রাজধানীর দ্রুতগামী যান হিসেবে পরিচিত মেট্রোরেল। ভোগান্তিহীন যাত্রা আর নিরাপদে নির্বিঘ্ন গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরে অল্প সময়েই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এই যানটি। উত্তরা ও মতিঝিলের দুই প্রান্ত সংযুক্ত করে দুই প্রান্তের মানুষের ও মধ্যবর্তী স্থানের মানুষের যাতায়াতে এটিই ছিল স্বপ্নের যান। তবে ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দুষ্কৃতকারীদের মেট্রো স্টেশনে হামলার ঘটনায় বন্ধ রয়েছে মেট্রোরেল চলাচল। ফলে অকল্পনীয় দুর্ভোগ ও পদে পদে ভোগান্তি বেড়েছে রাজধানীবাসীর।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতধরেই বাংলাদেশ প্রথম যাত্রা শুরু করে মেট্রোরেল। দিনে দিনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাড়তে থাকে যাত্রীর চাপ। ফলে মতিঝিল থেকে মিরপুর হয়ে উত্তরাগামী যাত্রাপথে লাঘব হয় দীর্ঘ যানজট। ভোগান্তিহীন যাত্রায় সাধারণ মানুষের সঙ্গী হয় মেট্রোরেল। তবে শিক্ষার্থীদের ডাকা কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মিরপুর ১০ নম্বর, কাজীপাড়া ও ফার্মগেট মেট্রোস্টেশনে হামলা চালায় দুষ্কৃতকারীরা। ভেঙে দেয়া হয় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন মেশিনপত্র। যেগুলো আগামী এক বছরেও মেরামত সম্ভব না বলেও জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আর এই সরকারি স্থাপনায় হামলা চালানোকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে মনে করছেন মেট্রোরেলে চলাচলকারী সাধারণ মানুষ।

সাধারণ মানুষের ভাষ্য, বর্তমান সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প সহ্য করতে পারছে না এক শ্রেণির মানুষ। তাই এই উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ করতেই এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছেন তারা।

সোমবার (২৯ জুলাই) রাজধানীর আগারগাঁও স্টেশন ও কারওয়ান বাজার স্টেশন এলাকা ঘুরে মেট্রোরেলে চলাচলকারী মানুষের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

রাজধানীর আগারগাঁও থেকে বার্তা২৪.কমের প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় মতিঝিলগামী মামুনের সঙ্গে। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। মামুন বলেন, 'আমাদের দেশের মানুষের সব থেকে বড় সমস্যা একজন অন্যের ভালো কখনোই দেখতে পারে না। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে হাতিয়ার বানিয়ে ধ্বংস করা হলো মেট্রো স্টেশন। কারণ কি? কেনো মেট্রোরেলে হামলা করা হলো? এটা সবাই ভালো করেই বুঝতে পারছে। এই সরকারের উন্নয়নের প্রশংসা করছে মানুষ। এটা তাদের সহ্য হচ্ছে না। তাই যাতে সরকার ঝামেলায় পারে সেই চেষ্টা করতেই এই মেট্রোরেলে হামলা করা হয়।'


তিনি বলেন, 'যখন মেট্রোরেল চলাচল করতো তখন মাত্র ১০ থেকে ১২ মিনিটে মতিঝিল চলে যেতে পারতাম। এখন আবার সেই ২ ঘণ্টাতেও পৌঁছাতে পারি না। এই সমস্যা তো শুধু আমার নিজের না। হাজার হাজারর মানুষের সমস্যা। প্রতিদিন মেট্রোরেলে লাখ লাখ মানুষ চলাচল করতো তাদের সবারই এখন বাসে যাতায়াত করতে হচ্ছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই রাস্তায় মানুষের চলাচলে চাপ বেড়েছে এবং যানজটও হচ্ছে। ভালোই হয়েছে সরকারের উচিত এটা আর ঠিক না করা। মানুষের বোঝা উচিত তারা তাদের নিজেদের সম্পদ নষ্ট করছে।'

মাহফুজ নামের অন্য এক মেট্রোরেলের যাত্রী বলেন, 'যখন মেট্রোরেল চলাচল স্বাভাবিক ছিল তখন মানুষ এই মেট্রোরেলের উপকারটা বুঝতে পারেনি। এখন বন্ধ হয়েছে জবুঝতে পারছে মেট্রোর কারণে কত সুবিধা ভোগ করেছে মানুষ।'

কারওয়ান বাজার স্যিগনালে বাসের অপেক্ষায় আছেন মিরপুরের বাসিন্দা মানিক। তিনি বলেন, 'মিরপুর ১০ নম্বরে আমার বাসা। কারওয়ান বাজারে ছোট একটা চাকরি করি। প্রতিদিন যাতায়াত করি। মেট্রোরেল চলাচলের কারণে আমাদের মিরপুরবাসীর যাতায়াতে অনেক সুবিধা ছিল। অল্প সময়ের মধ্যে যাতায়াত করতে পারতাম। কিন্তু এখন ২ ঘণ্টাতেও যেতে পারি না। তাও আবার বাসের গেটে ঝুলতে ঝুলতে।'

পলাশ নামের আরেক যাত্রী বলেন, 'মেট্রো থাকায় অফিসে যাতায়াত সহজ ছিল। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অফিসে পৌঁছে যেতে পারতাম কিন্তু এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় রাস্তার যানজটে বসে থেকে। কখনও কখনও আবার হেটে যেতে হয়। তারপরেও অফিসে লেট হয়ে যায়। নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে পৌঁছাতে পারি না। বসদের বিভিন্ন কথা শুনতে হয়।'

এদিকে সরকারি চাকুরিতে স্থায়ীভাবে কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। দফায় দফায় অবস্থান কর্মসূচি শেষে রোববার (৬ জুলাই) থেকে শুরু হয় ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি। রোব ও সোমবার টানা কর্মসূচি পালনের পর মঙ্গলবার বিরতি দিয়ে বুধবারের কর্মসূচি ঘোষণা করে আন্দোলনকারীরা। বুধবারের কর্মসূচি শেষ করে বৃহস্পতিবার কর্মসূচি ঘোষণা দেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নেতৃবৃন্দরা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এক দফা দাবিতে সারা দেশে পালিত হয় ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি।

‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ, বিজিবি, র‍্যাব, সোয়াটের ন্যাক্কারজনক হামলা ও সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিতের দাবিতে বুধবার (১৭ জুলাই) ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা দেন কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ।

তিনি বলেন, 'শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ওপর পুলিশ, বিজিবি, র‍্যাব, সোয়াটের ন্যাক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত ও এক দফা দাবিতে বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সারাদেশে কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করছি।'

এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) ঢাকাসহ সারা দেশে ২২৯ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। একই সঙ্গে মোতায়েন করা হয় র্যাব পুলিশ সহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকরী বাহিনীর সদস্যদের।

তবে আন্দোলনকারীদের ডাকা 'কমপ্লিট শাটডাউন' ঘিরে সৃষ্টি হয় সহিংসতা। রণক্ষেত্রে রূপ নেয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান। রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় চালানো হয় হামলা। আগুন দেয়া হয় সরকারি গাড়ি, পুলিশ বক্সসহ সরকারি ভবনে। ভাঙচুর করা হয় নগরবাসীর যাতায়াতের দ্রুতগামী যান মেট্রোরেলের দুটি স্টেশনেও।

এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেলের দুটি স্টেশন এক বছরেও চালু করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

এসময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে তিনি বলেন, 'মেট্রোরেল না থাকায় মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। ৩০ মিনিটের পথ দুই ঘণ্টায়ও যেতে পারছে না। মেট্রোরেল কবে নাগাদ চালু হবে তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।'

গত শনিবার (২৭ জুলাই) সকালে কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজধানীর মহাখালীতে ক্ষতিগ্রস্ত সেতুভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিদর্শন শেষে এ কথা বলেন ওবায়দুল কাদের।

সেতুমন্ত্রী বলেন, 'আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় মেট্রোরেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশন ধ্বংসপ্রাপ্ত। এটা এক বছরেও যন্ত্রপাতি এনে সচল করা সম্ভব হবে না বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।'

মেট্রোরেল চলাচল কবে নাগাদ শুরু হতে পারে জানতে চাইলে কাদের বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সিদ্ধান্ত নেবেন, ওই সিদ্ধান্তের ওপর আমরা পর্যায়ক্রমে যেখানে যা করার সেটা করব। তার সিদ্ধান্তের আগে আমরা কোনো কিছু করতে চাই না। তিনি সব কিছু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং তিনি প্রত্যক্ষভাবে বিটিভিসহ বিভিন্ন ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনায় গেছেন। সব কিছুর ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তার কাছে আছে। কী অবস্থায়, কখন, কোনটা চালু করা যাবে আমি এই মুহূর্তে বলতে পারছি না।'

তিনি আরও বলেন, 'এটা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কাজ নয়। তারা কোটার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। রাজনৈতিক মতলবে বিএনপি-জামায়াত এই আন্দোলনের ওপরে ভর করেছে তাদের দীর্ঘ দিনের ব্যর্থতা অবসানের জন্য। ২০১৮ সালে তারা ব্যর্থ হয়েছে, নির্বাচনের আগে অক্টোবর মাসে তারা ব্যর্থ হয়েছে, নির্বাচনে হেরে যাওয়ার ভয়ে তারা অংশ নেয়নি আজকে ক্ষমতার লিপ্সা তাদের পেয়ে বসেছে।'

প্রসঙ্গত, ৫ জুন সরকারি দফতর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন উচ্চ আদালত। ওই দিন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী আন্দোলনে নামেন। এ অবস্থায় আদালতের ওই রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আবেদনটির ওপর শুনানির জন্য ৪ জুলাই দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আবেদনটির ওপর শুনানি হয়, আপাতত আগের মতোই বহাল থাকছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা। তাই পূর্ব ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পালিত হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর