‘আমার বুকের মানিকরে কেড়ে নিলো কে? আমি কি করে বাঁচুমরে? আমার ছেলের কি অপরাধ ছিলোরে? তোরা আমার মানিকরে ফিরিয়ে দে, আমার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছেরে।’ একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে এভাবে বিলাপ করছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত কিশোর মো. ইউনূছ আলী শাওনের (১৭) বৃদ্ধ বাবা আবুল বাশার।
সরেজমিনে শাওনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলের কবরের পাশে কান্নাকাটি করছেন শাওনের হতদরিদ্র বাবা আবুল বাশার।
স্থানীয়রা জানান, পুলিশের গুলিতে ছেলে হারানোর পর থেকে কেঁদে চলছেন আবুল বাশার। কিছুতেই তার কান্না থামানো যাচ্ছে না।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের দক্ষিণ মাগুরী গ্রামের হত দরিদ্র পরিবারের মো. ইউনূছ আলী শাওন ঢাকার শনির আখড়া এলাাকার একটি কসমেটিকস দোকানের কর্মচারী ছিলেন।
এলাকাবাসী জানায়, শাওনের মত ভালো ছেলে হয় না। নিহত শাওনের প্রতিবেশী সাবেক মেম্বার হারুনুর রশিদ পাটওয়ারী ও সমাজকর্মী আনোয়ার হোসেন পাটওয়ারী বলেন, ওর মতো ভদ্র ছেলে এই গ্রামে আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। ঈদে বাড়িতে বেড়াতে এলেও দোকানে আড্ডা দিত না শাওন।
লক্ষ্মীপুর জেলার সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ড দক্ষিণ মাগুরী গ্রামের ক্বারি সাহেবের বাড়ির হতদরিদ্র বৃদ্ধ আবুল বাশারের দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভের একমাত্র সন্তান মো. ইউনূছ আলী শাওন। আবুল বাশারের প্রথম স্ত্রী দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে মারা গেলে তিনি শাওনের মা কুলছুম বেগমকে বিয়ে করেন। কুলছুম বেগমের গর্ভে শাওনের জম্ম। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে জম্ম নেওয়া বড় ছেলে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। পরিবার নিয়ে তিনি ঢাকায় থাকেন। যে বেতন পান তা দিয়ে স্ত্রী সন্তানের ভরণপোষণ আর বাসাভাড়া দিয়ে চলতেই কষ্ট হয় তার।
বাবা মাকে দুই পয়সা দেওয়ার সুযোগ হয় না বড় ছেলের। আরেক ছেলে মানসিক রোগী। নিয়মিত ঔষধ না খাওয়ালে তার রোগ বেড়ে যায়। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। পরিবারের সহায় সম্বল বলতে এক চিলতে বসতভিটা ছাড়া আর কিছুই নেই। গ্রামের রাস্তায় সবজি লাগিয়ে এবং অন্যের জমি বর্গা চাষ করে যা পান তাই পরিবারের আয়। শাওনই এই হতদরিদ্র পরিবারের একমাত্র নগদ টাকা আয়ের উৎস ছিল।
পরিবারের অভাব অনটনের কারণে শাওনের পড়ালেখা করা সম্ভব হয়নি। গ্রামের মাদরাসা থেকে ৫ম শ্রেণি পাস করার পর পরই ফুফাতো বোনের জামাইয়ের সাথে চলে যান ঢাকায়। ঢাকার শনির আখড়া এলাকায় বোন জামাইয়ের কসমেটিক দোকানে সেলসম্যানের চাকরি করতো শাওন। গত ৮ বছর ধরে শাওন ভগ্নিপতি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বসিকপুর গ্রামের মোল্যা বাড়ির শাহজাহানের কসমেটিকস দোকানে চাকরি করে আসছেন।
গত ২০ জুলাই দুপুরে প্রতিদিনের মত শাওন দোকান বন্ধ করে খাবার খেতে বাসায় ফিরছিলেন। দোকানের বাইরে আসার পরপরই পুলিশের ছোড়া দুটি গুলি এসে লাগে শাওনের বুকে ও পেটে। বুকের গুলিটি শরীর বেদ করে বেরিয়ে যায়। শাওন লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। এক সময় গুলিবর্ষণ বন্ধ হলে উপস্থিত লোকজন এসে শাওনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতালে নেওয়ার আগে শাওন তার পকেটে থাকা মোবাইল দেখিয়ে উদ্ধারকারী একজনকে বলেন আব্বু নামে আমার বাবার মোবাইল নম্বরটি সেভ করা আছে আমার খবরটি বাবাকে জানিয়ে দিন। শাওনের কথামতো তিনি আবুল বাশারকে তার ছেলে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর জানান।
ছেলের মোবাইল থেকে ফোন পেয়ে আবুল বাশারের মনে আনন্দ দেখা দিলেও খবরটি পেয়ে যেন আকাশ ভেঙে তার মাথায় পড়ে। চিৎকার দিয়ে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। সবাই ছুটে এসে জানতে পারেন শাওন আর এই দুনিয়াতে নেই। খান খান হয়ে যায় আবুল বাশার ও তার স্ত্রী কুলছুম বেগমের লালিত সব স্বপ্ন।
গ্রামবাসী জানায়, এক সময় একটি বসত ঘরের অভাবে রোদেপুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে আবুল বাশারের পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করতো। পরবর্তীতে গ্রামের লিটনসহ কয়েকজন সহযোগিতা করে আবুল বাশারকে টিনের একটি বসত ঘর তৈরি করে দেন।
বাড়ির সামনেই পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে কিশোর শাওনকে। ছেলের কবর দেখাতে নিয়ে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়েন আবুল বাশার। ঘরে গিয়ে দেখা যায় নামাজের বিছানায় বসে পুত্রের জন্য দোয়া করছেন মা কুলছুম বেগম।
একমাত্র সন্তান নিহত হওয়ার পর থেকেই নির্বাক হয়ে গেছেন কুলছুম বেগম। কারো সাথেই তেমন কথা বলছেন না তিনি। খাওয়া দাওয়া সব ছেড়ে দিয়ে বেশির ভাগ সময়ই তিনি ছেলের জন্য দোয়া কালাম পড়ে সময় পার করছেন।
তাকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা কারো নেই। আর কি বলেই বা তাকে সান্তনা দিবেন? সে ভাষাও কারোরই জানা নেই।