পড়ন্ত বিকেল। আকাশজুড়ে কালো মেঘ। বৃষ্টি আসি আসি। আকাশে এমন মেঘের ঘনঘটা দেখেই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে’। কিন্তু টিভি আর অনলাইনে ভর করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবরটা চট্টগ্রামে উড়ে আসতেই মানুষ আর ঘরে থাকলেন না। নেমে এসেছেন সড়কে। বন্দরনগরীর সব পথ এখন যেন এখন জনসমুদ্র। কেউ এসেছেন ছোট্ট সন্তানকে কাঁধে নিয়ে, কেউ বা এসেছেন সন্তানের হাত ধরে। সবার চোখেমুখে উচ্ছ্বাস, ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। বিজয় মিছিল চলছে।
সোমবার (৫ আগস্ট) বিকেল চারটার মধ্যেই নগরীর কাজির দেউড়ি মোড়ে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হন। সেই ভিড়ের এক কোণে মাকে জড়িয়ে কাঁধছিলেন মোহাম্মদ আলভি। ৩৫ বছরের তরুণের কান্না থামছিলই না। মা বারবার চোখের পানি মুছে দিচ্ছিলেন। কিন্তু না, আলভিকে থামানো যাচ্ছে না। কাছে গিয়ে কি হলো জানতেই, কান্না সংবরণ করলেন তিনি। বললেন, ‘আমি কাঁদছি সেই সব বীরদের জন্য, যাদের প্রাণের বিনিময়ে আজ আমরা নতুন করে বিজয় পেলাম। কিন্তু তারা তো সেটি দেখে যেতে পারলেন না। আমরা তো ভয়ে সেভাবে কিছুই করতে পারলাম না। তারাই সব করলেন, আজ কিনা তারাই নেই এই বিজয় মিছিলে।’
কাজির দেউড়ি থেকে জামালখানের দিকে যতই এগোতে থাকি, ততই জনস্রোত। সেই স্রোত কেটে জামালখান মোড়ে পৌঁছতেই আবার পড়তে হয় বিজয়উল্লাসের সামনে। সেখানে দলবেঁধে স্লোগান দিচ্ছিলেন তরুণ-তরুণীরা। কয়েকজন তরুণ-তরুণী বার্তা২৪কম-কে বলেন, ‘আজ শুধু উল্লাস হবে। আমরা কথা বলতে পারতাম না, স্বাধীন দেশে থেকেও যেন ভয়ের সংস্কৃতি আমাদের মাঝে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আজ আমাদের কথা বলার দিন, আজ আমাদের সব দুঃখ ঝাড়ার দিন।’
জামালখান থেকে প্রেসক্লাব হয়ে চেরাগী পৌঁছতেই পাওয়া গেল সংস্কৃতিকর্মীদের। তার ঢোল-তবলা বাজিয়ে দলবেঁধে বিজয়ের গান গাইছিলেন। তাদের কণ্ঠে কখনো ভর করছিল স্বাধীনতার সেই অমর সংগীত ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান লেখা আছে অশ্রুজলে’ আর ‘আমরা ক'জন নবীন মাঝি, হাল ধরেছি...।’ গানের ফাঁকে ফাঁকে চলছিল মিষ্টি বিতরণও। সেখানে সংস্কৃতিকর্মী উর্মি বড়ুয়া, আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসি। কিন্তু আমাদের সেই দেশটাকে যেন ধ্বংসের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছিল একটা গোষ্ঠী। স্বাধীন দেশে থেকেও মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারছিল না। প্রতিবাদ করলেই গুলি করে খুন করা হচ্ছিল। সেই সব পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকেই আমরা পেলাম নতুন দিন।’
একদিন আগের দুপুরে নিউমার্কেট মোড় থেকে ছাত্র-জনতাকে গুলি আর টিয়ারশেল মেরে সরিয়ে দিয়েছিলেন পুলিশ আর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। সেই নিউমার্কেট আবার পুর্নদখল করল ছাত্র জনতা। আগেরদিন ছিল গুলি আর টিয়ারশেলের ভয়, আজ নেই কোনো ভয়।
নিউমার্কেট মোড়ের ভাস্কর্যের ওপর দাঁড়িয়ে আন্দোলনচলার সময় অনেকেই পতাকা উড়িয়ে ছবি তুলেছেন। সেই ছবিগুলো কোটা আন্দোলনের অন্যতম আইকনিক ছবি হিসেবে পরিণত হয়েছিল। সোমবার বিকেলে ফের সেই একই দৃশ্য দেখল বন্দরনগরী। সেই ভাস্কর্যের ওপর দাঁড়িয়ে অনেকেই বিজয় স্লোগান দিচ্ছিলেন, পতাকা উড়াচ্ছিলেন।
সেখানে পাঁচ বছরের কন্যাসন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন বাবা সহিদ উল্লাহ ও মা সাহিদা আক্তার। তারা বলেন, ‘একটা ন্যায্য দাবির জন্য আমাদের সন্তানেরা মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু তাদের কোনো কথাই প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীরা শোনেননি। উল্টো বুকে গুলি চালিয়েছেন, ছাত্রলীগ-যুবলীগকে লেলিয়ে দিয়েছেন। সেই সব দম্ভরা আজ কোথায়? আল্লাহ ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না। এটা সবাইকে বুঝতে হবে।’
বিজয় উল্লাসের অপরপিঠে কোথাও কোথাও ভাঙচুর-আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। তবে সাধারণ মানুষ চান না এমন কিছু। তাদের কথা, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে এসেছে মানুষের এই জয়। কোনো হিংসা যেন সেই অর্জনকে খাটো করে না দেয়।